অনুমোদন ছাড়াই রাসায়নিক পদার্থের ব্যাবসা চলছে দেশের সর্বত্র
স্টাফ রিপোর্টার,
প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়া রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসা চলছে দেশের সর্বত্র। নজরদারি এড়িয়ে এবং নিয়মনীতির পরোয়া না করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মজুদ করা হচ্ছে দাহ্য ও বিস্ফোরক উপকরণ। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিকে প্রতিনিয়ত সঙ্গী বানিয়ে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে অসংখ্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পণ্য মজুদ করছে সারা দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। শুধু ঢাকা মহানগরীতে এমন প্রতিষ্ঠান ৮৬৭টি। এ তালিকায় আছে রাসায়নিক উপকরণ বিক্রেতা, প্রসাধন ও ওষুধ প্রস্তুতকারক, চামড়া, ইস্পাত কারখানা, ডায়িং-ওয়াশিং, টেক্সটাইল শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠান। তালিকা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সদরঘাট ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন এলাকায় ছাড়পত্র ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পণ্য মজুদকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৬১টি। মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন হাজারীবাগ এলাকায় এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২০৯টি। লালবাগ স্টেশনাধীন এলাকায় রয়েছে ৮৭টি, পোস্তগোলায় ৪৩, সিদ্দিকবাজারে ৪২ এবং মিরপুর ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন এলাকায় এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৬টি। অধিকাংশ এলাকায়ই আবাসিক হোল্ডিংয়ে রাসায়নিক পণ্য মজুদ ও বিপণনকারী বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বহু এলাকায় অপরিসর দোকানে হার্ডওয়্যার পণ্যের সঙ্গে গাদাগাদি অবস্থায় রেখে বিক্রি করা হচ্ছে নানা রকম রাসায়নিক পণ্য। একইভাবে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র না নিয়ে রাসায়নিক মজুদ ও ব্যবহার হচ্ছে শ্যামপুর, ডেমরা, সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ইনসুলেশন, রাবার, ট্যালকসহ নানা ধরনের প্রক্রিয়াকরণ কারখানায়।
চট্টগ্রামেও রাসায়নিক ব্যবসার বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে অনুমোদন ছাড়াই। নগরীর টেরিবাজার, বক্সিরহাট, বান্ডেল রোড, আছদগঞ্জ ও খাতুনগঞ্জে রয়েছে রাসায়নিক পণ্যের শতাধিক দোকান ও গুদাম। একই পণ্যের কিছু গুদাম আছে মাঝিরঘাটে।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্যমতে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জে রাসায়নিক পণ্যের অনুমোদনহীন গুদাম ও দোকানের সংখ্যা শতাধিক। আর চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম শ্রেণীর পেট্রোলিয়ামভুক্ত প্রজ্বলনীয় তরল রাসায়নিকের লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ৭৫টি। এর মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান আমদানি ও বিক্রয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত। আমদানি, বিক্রয় ও মজুদের অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠানও খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ বা চাক্তাইয়ের নয়। অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স নিয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার ঠিকানা ব্যবহার করে। ব্যতিক্রম শুধু নগরীর বলুয়ারদীঘির পাড়ের মেসার্স আল আমিন কেমিক্যাল।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. তফাজ্জল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রামে রাসায়নিক বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জে। কিন্তু অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন থানা ও উপজেলার। বিষয়টি সন্দেহজনক।
ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের পর এ এলাকার ব্যবসায়ীরা রাসায়নিকের ড্রাম ও নমুনা সরিয়ে নিয়েছেন। আগে ফুটপাতে, দোকানে রাসায়নিক রাখা হলেও এখন গুদামে রেখে দিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান এক সপ্তাহ ধরে দোকান বন্ধ রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা ক্রেতা এলে গলির ভেতরে নিয়ে রাসায়নিক সরবরাহ করছেন।
এদিকে সিলেটে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া যথেচ্ছা গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। নগরীর পান দোকান, মুদি দোকান, ওষুধের দোকান, লন্ড্রি, সিমেন্ট, কসমেটিকসের দোকান, লাইব্রেরি এমনকি ফুটপাতের ছোটখাটো দোকানেও অবাধে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে।
বিস্ফোরক আইন ১৮৮৪ বিধির ৭১ নং ধারায় বলা আছে, আগুন নেভানোর জন্য স্থাপনা বা মজুদাগারে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম মজুদ রাখতে হবে। এ আইন অমান্য করলে ওই ব্যবসায়ী ন্যূনতম দুই বছর এবং অনধিক পাঁচ বছরের জেল এবং অনধিক ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থ অনাদায়ী থাকলে অতিরিক্ত আরো ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সিলেট বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলায় ৪৮৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে বিস্ফোরক লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টির অধিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. আলীম উদ্দিন বলেন, বিস্ফোরক লাইসেন্স এক বছরের মেয়াদে দেয়া হয়। প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। সিলেটে অনেকে লাইসেন্স ছাড়া সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা করছেন। অনেকে লাইসেন্স নবায়ন না করে ব্যবসা করছেন। পুরো সিলেট জেলায় প্রায় ৪৫০ জন ব্যবসায়ীর লাইসেন্স থাকলেও শুধু নগরীতেই সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির দোকান পাঁচ শতাধিক, যার বেশির ভাগই অবৈধ।
লোকবল সংকটের কারণে অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ঢাকায় কর্মরত এবং সিলেটে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। জনবল সংকটের কারণে বেশির ভাগ সময় মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনেও যেতে পারি না। এসব বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিসের সহকারী পরিচালক তন্ময় বিশ্বাস বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসা করা অনেক বিপজ্জনক। গ্যাস সিলিন্ডার ডিলাররা ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করলেও খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই ব্যবসা করছেন।’
নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য ও বিস্ফোরক পণ্যের ব্যবসা চলছে পূর্বাঞ্চলীয় শহর নোয়াখালীতেও।