মেজর(অব:) মান্নানের শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা চায় দুদক

ভূইয়া আসাদুজ্জামান,
ঢাকা, লিগ্যাল ডেস্ক : বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানির(বিআইএফসি) সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এমএ মান্নান এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠজনের নামে থাকা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঋণের অর্থ আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা যাতে বহাল থাকে, সেজন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। তবে শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এখতিয়ারে থাকায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএসইসিকে অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মেজর (অব.) এমএ মান্নানের শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দপ্তরে চিঠিটি পাঠায় দুদক। কমিশনের সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এমএ মান্নান ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে তার নিজের ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৭৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৫১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ ঋণের পরিমাণ প্রতিষ্ঠানটির মূলধনের ৬০ শতাংশের বেশি। দুদক বিষয়টির অনুসন্ধান শুরু করার পর মেজর (অব.) এমএ মান্নান সব ঋণের দায় স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকে অঙ্গীকারপত্র প্রদান করেন। ১১৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধও করেন। বর্তমানে সুদ ছাড়া মেজর (অব.) এমএ মান্নানের কাছে বিআইএফসির পাওনার পরিমাণ ৩৯৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। তিনি বিআইএফসির অবশিষ্ট এ পাওনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত তা পরিশোধ করেননি। তাই ঋণের টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত মেজর (অব.) এমএ মান্নান এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠজনের নামে থাকা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন বলে মনে করে দুদক।

দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির চেয়ারম্যান বরারর চিঠি পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, শেয়ার হস্তান্তরসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিএসইসির প্রাধিকারভুক্ত হওয়ার কারণে এ বিষয়ে আপনাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হলো।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাওয়ার বিষয়টি বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান।

২০১৫ সালে বিআইএফসির ঋণ প্রদানে অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তেই উঠে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুসারে, বিআইএফসি থেকে অনিয়ম ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে সানম্যান গ্রুপের অনুকূলে ৫১৮ কোটি টাকার ঋণ প্রদানের প্রমাণ পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে আরো উঠে আসে, এসব ঋণের সুবিধাভোগী সানম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এমএ মান্নান।

ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর বিআইএফসির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় ওই মাসেই বিআইএফসির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুকুজা ভেঞ্চার লিমিটেড ও কাঞ্চি ভেঞ্চার লিমিটেড নামে দুটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিআইএফসির পর্ষদে আসে। এর মধ্যে সুকুজা ভেঞ্চারের প্রতিনিধি হিসেবে ইরফান উদ্দীন আহমেদ পর্ষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে চার মাসের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর ১ আগস্ট সুকুজা ভেঞ্চারের প্রতিনিধি হিসেবে নতুন পর্ষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক রুহুল আমিন, এফসিএ।

বিআইএফসির বর্তমান চেয়ারম্যান রুহুল আমিনের কাছে মেজর (অব.) এমএ মান্নান এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠজনের নামে থাকা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছরের শেষ দিকে আমি মেজর (অব.) এমএ মান্নানকে ঋণের বিষয়টি নিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।

কী প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ওনাকে ৭৮০ কোটি টাকা ঋণের বিষয়টি স্বীকার করে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ঋণের বিষয়টি তিনি স্বীকার করে কিস্তিতে পরিশোধে রাজি হলে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণটি পুনঃতফসিলের জন্য প্রস্তাব পাঠাতাম। এতে বিআইএফসির খেলাপি ঋণের বোঝা কমার পাশাপাশি মেজর (অব.) এমএ মান্নানও ঋণের দায় থেকে মুক্ত হতে পারতেন।

মেজর (অব.) এমএ মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে মেজর (অব.) এমএ মান্নানের কারণে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বিআইএফসি। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর (অব.) এমএ মান্নানের সানম্যান গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিআইএফসির ঋণের পরিমাণ ৬২১ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৭৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। সানম্যান গ্রুপের আলোচ্য ঋণের পুরোটাই খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকৃত করা হয়েছে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *