ভবনে অগ্নিঝুঁকি কমাতে স্থপতি ইনস্টিটিউটের ৯ সুপারিশ
ভূঁইয়া আসাদুজ্জামান,
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি) আশু ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় কার্যক্রম নির্দিষ্ট করে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। স্থপতিদের প্রতিনিধিত্বকারী পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে আইএবি ‘অগ্নিনিরাপত্তা ও জীবন সুরক্ষা: নির্মিত ও নির্মিতব্য ভবনের জন্য করণীয়’ বিষয়ে তাদের বক্তব্য ও প্রস্তাবনা তুলে ধরতে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত আইএবি সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ, স্থপতি রফিক আজম, স্থপতি ইকবাল হাবিব, স্থপতি এহসান খান, স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ প্রমুখ।
অগ্নিদুর্ঘটনায় আশু করণীয় হিসেবে সংগঠনটি বলছে, রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে আগে নির্মিত ভবনগুলোয় জীবন রক্ষা নিশ্চিতকরণ, হালনাগাদকৃত বিএনবিসি অতিসত্বর অনুমোদন ও ভবন নির্মাণে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ, ভবনের ‘অকুপেন্সি সার্টিফিকেট’ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটিকে কার্যকরী ভূমিকায় নিয়ে আসা, রাজউকের রেগুলেটরি কার্যক্রম আরো জোরদারকরণ এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইনে ব্যবহূত নির্মাণসামগ্রীর ফায়ার রেটিং নিশ্চিতকরণ।
আর দীর্ঘমেয়াদি করণীয় হিসেবে যেসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো হলো, অগ্নিনিরাপত্তা ও জীবন সুরক্ষা বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করা, অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে এ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত নকশা প্রণয়নে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ। এছাড়া অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও এতে বলা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে আইএবির সভাপতি স্থপতি জালাল আহমেদ বলেন, আমরা সবাই এ বিষয়ে অবগত যে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঢাকা শহরের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে প্রণীত বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট ১৯৫২ এর আওতায় ১৯৫৩ সালে সর্বপ্রথম নগরে ভবন নির্মাণের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর ১৯৮৪ ও ১৯৯৬ সালে এ বিধিমালা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। পরিবর্তিত বিধিমালায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব ছিল এবং ঢাকা মহানগরীর ভৌত, অবকাঠামোগত, পরিবেশগত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাহিদাগুলোর এত দ্রুত পরিবর্তন হবে—এ বিষয়ে দূরদৃষ্টির অভাব ছিল।
তিনি বলেন, ১৯৮৪ এর বিধিমালায় বাণিজ্যিক ভবনের দুই পাশে জায়গা ছেড়ে নির্মাণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সাততলার উঁচু ভবনে জরুরি নির্গমন সিঁড়ির বিধান রয়েছে। ১৯৯৬ এর বিধিমালায় নয়তলা পর্যন্ত উঁচু ভবনে দুই পাশে জায়গা ছেড়ে নির্মাণের বাধ্যবাধকতা নেই। এর চেয়ে অধিক তলাবিশিষ্ট ভবনে দুই পাশে ২ দশমিক ৫ মিটার জায়গা ছাড়ার বিধান রাখা হয়েছিল। ২০০৬ সালে আইএবির উদ্যোগে অন্য দুটি পেশাজীবী সংগঠন আইইবি ও বিআইপি এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবসহ স্বেচ্ছাসেবী ও দীর্ঘদিনের শ্রমের ফসল হিসেবে ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা প্রণীত হয়। এ বিধিমালায় প্রথমবারের মতো পরিবেশ, অগ্নিনিরাপত্তা, সর্বজনীন গম্যতা ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৩ সালে স্থপতি ও প্রকৌশলী বিশেষজ্ঞদের একটি বিশাল দলের সমন্বয়ে সরকার বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে বিএনবিসি আইন দীর্ঘদিন থমকে থাকে। পরে তেজগাঁও শিল্প এলাকার ফিনিক্স ভবন ধসের পর ২০০৬ সালে বিএনবিসি আইন হিসেবে স্বীকৃত হয়।
অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিএনবিসি ছাড়াও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের আইন রয়েছে। ভবনে অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত দুর্বল বৈদ্যুতিক নকশা ও সরঞ্জামাদির বিভ্রাট। এ বিষয়ে ডেসা ও ডেসকোর আইন রয়েছে। দশের অধিক তলাবিশিষ্ট সব ভবনের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নকশা অনুমোদনের বিধান আছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রণীত এ আইনগুলো সমন্বয়হীন ও সাংঘর্ষিক। এ সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী এবং লোভী গোষ্ঠী অনিরাপদ ভবন নির্মাণ করছে। ২০০৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ভবন নির্মাণ শেষে রাজউক কর্তৃক পরিদর্শন এবং ব্যবহার সনদ ব্যতীত ভবনে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ না দেয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বিধিমালার পরবর্তী সংস্করণে এ শর্ত বিলোপ করা হয়। ফলে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণে উৎসাহিত করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এটা স্পষ্ট যে ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত আইনে সীমাবদ্ধতা ছিল এবং পরবর্তীতে আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রয়োগ ও তদারকির দুর্বলতার কারণে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণের সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। এছাড়া রাজউক এলাকাসহ সারা দেশে স্থপতিদের স্বাক্ষর জাল করে নকশা অনুমোদনের বিষয়টি মহামারী আকার ধারণ করেছে। এ কাজে একটি অসাধু চক্র জড়িত।