রাজা সীতারাম রায়ের রাজপালঙ্ক ডিসির বাসভবনে

নিজস্ব প্রতিবেদক,

লিগ্যাল ভয়েস ডেস্ক : রাজপালঙ্ক অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রাজাদের অস্তিত্ব না থাকায় এ ধরনের প্রত্নসামগ্রী এখন শোভা পায় দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে। কিন্তু ৩০০ বছরের বেশি পুরোনো রাজা সীতারাম রায়ের একটি পালঙ্কের খোঁজ পাওয়া গেছে মাগুরার জেলা প্রশাসকের বাসভবনে। জেলা প্রশাসক (ডিসি) আলী আকবর পালঙ্কটি ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছেন।

ডিসি আলী আকবর বলেন, পালঙ্কটি তাঁর বাসভবনে সংরক্ষিত রয়েছে। এটি তিনি মেরামত করেছেন। ইতিহাস ঘেঁটেজানা যায়, ১৬৮৬ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজসভা থেকে রাজা উপাধি লাভ করেন সীতারাম রায়। তাঁর রাজত্বের সীমারেখা ছিল উত্তরে পাবনা ও দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত। প্রতাপশালী এই রাজা রাজধানী গড়ে তোলেন মাগুরার মহম্মদপুরে। কীর্তি হিসেবে সেখানে এখনো রয়েছে তাঁর রাজপ্রাসাদ, কাচারিবাড়ি, দোলমঞ্চসহ অনেক কিছু। রাজত্বকালে তিনি গড়ে তোলেন অস্ত্র তৈরির কামারশালা।

প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর রাজপ্রাসাদ ও দোলমঞ্চ সংস্কারের কাজ করলেও কালের বিবর্তনে রাজপ্রাসাদ থেকে হারিয়ে গেছে রাজার ব্যবহৃত অনেক কিছুই। রাজা সীতারামের অস্ত্রভান্ডারের স্মৃতি হিসেবে অস্ত্রসহ কিছু সামগ্রী মহম্মদপুর থানায় পুলিশের মালখানায় সংরক্ষিত আছে। আর সীতারামের একটি পালঙ্ক দীর্ঘদিন ধরে ছিল মাগুরা জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ ও সংস্কারকাজের সময় প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শন ট্রেজারি থেকে কখনো রেকর্ড রুমে ও কখনো জিমখানার অন্যান্য অব্যবহৃত উপকরণের পাশে জায়গা পেয়েছে। সব শেষ পালঙ্কটি ছিল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড রুমে দলিল-দস্তাবেজের সঙ্গে।

জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, ডিসির কার্যালয় থেকে চার মাস আগে পালঙ্কটি নিয়ে যাওয়া হয় ডিসির বাংলোয়। এটি ডিসি আলী আকবরের শয়নকক্ষে স্থান পেয়েছে বলেও একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে ওই সূত্র বলেন, ‘স্যার (ডিসি) তো এটিতে ঘুমান।’

মাগুরার সাবেক জেলা প্রশাসক আতিকুর রহমান ও মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসনেরএক কর্মচারী এ পালঙ্ক চুরির চেষ্টা করেছিলেন। তখন সেটি উদ্ধার করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রাখা হয়। বর্তমানে রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) ও মাগুরার সাবেক জেলা প্রশাসক আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমি গত বছরের অক্টোবরে দায়িত্ব ছেড়ে আসার সময় পালঙ্কটি রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত ছিল।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) রাজীব চৌধুরীর সহায়তায় গোপনে পালঙ্কটি রেকর্ড রুম থেকে বের করে ডিসির বাংলোয় নিয়ে যাওয়া হয়, যে কারণে জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুম বা ট্রেজারিতে এ বিষয়ে কোনো তথ্য রাখা হয়নি। তবে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা। ২৯ মে দুপুরে এনডিসি রাজীব চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এখানে আসার পর শুনেছি এ রকম একটি খাট ছিল। তবে এটি এখন কোথায় আছে, খুঁজে দেখতে হবে।’ রাজীব চৌধুরী এখানে যোগ দেন গত ১৮ জানুয়ারি। তাঁর আগে এখানে এনডিসি ছিলেন বর্তমানে প্রশিক্ষণে থাকা মো. ইসাহাক আলী। তিনি মুঠোফোনে বলেন, পাঁচ মাস আগে তিনি দায়িত্বে থাকাকালে পালঙ্কটি জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত ছিল।

এ বিষয়ে বর্তমানে রেকর্ড রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘এ রকম একটি পালঙ্ক ছিল বলে শুনেছি। এটি এখন কোথায় আছে, তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খানবলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো নিদর্শন কারও ব্যক্তিগত ব্যবহারের বা বেডরুমে রাখার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘লোকবলের সংকট থাকায় এসব সংরক্ষণের জন্য আমাদের স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারও কাছে কোনো নিদর্শন সংরক্ষিত থাকলে তা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে জমা দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে একটি চিঠি দেওয়া হয় সব জেলার জেলা প্রশাসক বরাবর।’

তবে জেলা প্রশাসক আলী আকবর বলেন, এ ধরনের কোনো চিঠি তাঁর নজরে আসেনি। উল্টো মাগুরা প্রশাসন থেকে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে জাদুঘরে এই পালঙ্ক নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসক বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ ধরনের উদ্যোগ নিলে অবশ্যই এগুলো তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *