প্রাথমিক শিক্ষার দুর্নীতিবাজ ডিজিকে সরাতে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড

স্টাফ রিপোর্টার,

লিগ্যাল ভয়েস ডেস্ক : ড. মো: আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বহু আলোচিত-সমালোচিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) সাবেক ডিজি। বর্তমানে তিনি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ডিজি পদে থাকাকালীন সরকারের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ বিভাগটিকে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের মহাক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন। মুখে শিক্ষার আলো ছড়ানোর বুলি আওড়ালেও ডিপিইতে তিনি অনেকটা লুটপাট ও ত্রাসের রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ উচ্চবাচ্য করলে তিনি তাকে ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকি, হয়রানিসহ শাস্তিমূলক বদলি করতেন। ড. আবু হেনার অপকর্ম, অযোগ্যতা, অদূরদর্শিমূলক নীতির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষা মাধ্যমটির বহু শিক্ষামূলক কর্মসূচি। তার কাজে, আচরণে ও হয়রানিতে অতিষ্ট হয়ে ডিপিই’র অনেক যোগ্য, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে তার কালো হাতের থাবা থেকে বাঁচাতে ওই সময় অনেকে তার বদলি অথবা প্রত্যাহারের জন্য জোর চেষ্টা-তদবির চালিয়েছেন। কিন্তু তার ক্ষমতা এতই প্রবল ছিল যে, যারাই তার বদলি অথবা প্রত্যাহারের চেষ্টা করেছিলেন উল্টো তাদেরকেই বদলি অথবা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তার রোষানলের স্বীকার সেই রকম একজন কর্মকর্তা হচ্ছেন তখনকার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামান।

তিনি এ মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালীন আবু হেনা মোস্তফা কামালের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও দায়িত্বে অবহেলার কথা তুলে ধরে তাকে বদলি অথবা প্রত্যাহারের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের অন্য প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারণে আবু হেনার কিছুই হয়নি। উল্টো আসিফ-উজ-জামানকে মাত্র দু’সপ্তার মাথায় শাস্তিমূলক বদলি হতে হয়েছিল। যা প্রশাসনে ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন ও দুঃখজনক ঘটনাগুলোর একটি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামান ডিপিই’র সাবেক ডিজি আবু হেনা মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে তাকে বদলি বা প্রত্যাহারের জন্য ০৩-০৯-২০১৮ইং তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহমদ বরাবর একটি ডিও লেটার অর্থাৎ আধাসরকারি পত্র প্রেরণ করেছিলেন। যার স্মারক নং- ৩৮.০০.০০০০.০১৫.০০.০০১৪.১৭-৪০৬। পত্রে আনীত অভিযোগগুলো হলো, মাঠ প্রশাসনের কাজে ড. মোস্তফা কামালের তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই, তার খামখেয়ালীপনা ও তথ্য সরবরাহে অদক্ষতার কারণে মন্ত্রণালয়ের কাজ পদে পদে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য হ্রাসের নিমিত্তে ধর্মঘট চলাকালীন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশানুযায়ী তিনি প্রাথমিক শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের একাধিক সংগঠনের সাথে আপোস করতে কার্যত ব্যর্থ হন, তার অদক্ষতায় ডিপিই’র শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণের সাথে স্থানীয় মাঠ প্রশাসনের সমন্বিত কাজগুলো সম্পাদনে সবাইকে বেগ পেতে হয় ইত্যাদি। সেই সাথে উক্ত পত্রে ড. কামালকে সরিয়ে তার স্থলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ডিজি হিসেবে মো: গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে পদায়নের সুপারিশ করা হয়।
পত্রে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অধীন ৩.৫ লক্ষ শিক্ষক ও কর্মকর্তার মাধ্যমে ২ কোটির অধিক বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছে। অধিকন্তু এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণ স্থানীয় প্রশাসনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে স্থানীয় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিভিন্ন শুমারী ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ সরকারের নির্দেশানুযায়ী দক্ষতার সাথে সম্পাদন করে থাকেন।

মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়নযোগ্য উক্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক কর্তৃক সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা হয়। পত্রে আরও বলা হয়েছিল, “প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে বর্তমানে কর্মরত মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল এনডিসি (আইডি-৪০২৪) এই অধিদফতরে গত ০৫-০১-২০১৫ইং তারিখে অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। এবং ২৮-১২-২০১৬ইং তারিখ থেকে মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করে অদ্যাবদি এ পদে কর্মরত আছেন। তিনি দীর্ঘদিন সচিবালয়ে একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন বিধায় মাঠ প্রশাসনে তার কাজের কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কীয় কাজ মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে সমন্বয় করতে অপারগ হন এবং বিভিন্ন সময় অসম্পূর্ণ তথ্য প্রদান করে এ মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধার সৃষ্টি করেন।

বিগত প্রাথমিক শিক্ষা ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশানুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণের একাধিক সংগঠনের সাথে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনি ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। তার ব্যর্থতার কারণে শিক্ষকগণ আবারো ধর্মঘটে যাওয়ার কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। তিনি শিক্ষক কর্মচারীদের সাংগঠনিক দাবি দাওয়াসমূহ একজন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই কর্মকর্তার মাধ্যমে অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ মাঠ পর্যায়ে সময়মতো ও সুষ্ঠভাবে সমন্বয় ও সম্পাদন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য বলে প্রতীয়মান হয়।”

পত্রে বলা হয়েছিল, মো: গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি এ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব ও যুগ্মসচিব হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে এ মন্ত্রণালয়ে এবং এর অধীনস্থ দফতর ও অধিদফতরের সংস্থাপন, প্রশাসন ও উন্নয়ন বিষয়ক কার্যাদি দক্ষতার সাথে সম্পাদন করেছেন। তিনি  জনপ্রশাসনে মাঠ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসক হিসেবে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্রে বলা হয়, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ মাঠ প্রশাসন এবং এ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত কাজে তার দীর্ঘ দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে দাফতরিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ সকল কাজের মাঠ পর্যায়ে সার্বিক সমন্বয় ও বাস্তবায়ন সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন। তাই উক্ত পত্রে বিষয়টির বাস্তব গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এনডিসি কে বর্তমান পদ থেকে অবিলম্বে প্রত্যাহার/অন্যত্র বদলী করে তার স্থলে মো: গিয়াস উদ্দীন আহমেদকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ/বদলী করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহমদকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

জনপ্রশাসন সচিব বরাবর ড. মোস্তফা কামালকে প্রত্যাহারের নিমিত্তে পত্র প্রেরণ করা হলে, পত্রের অভিযোগ আমলে না নিয়ে উল্টো সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামানকে বদলি করা হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আসিফ-উজ-জামান আধা সরকারি পত্রটি লিখেছিলেন ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ইং তারিখে। এর দু’সপ্তার মাথায় ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ইং তারিখে উল্টো সচিব আসিফ-উজ-জামানকেই প্রত্যাহারের আদেশ জারি করেন জনপ্রশাসন সচিব।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: তমিজুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত ১৯/০৯/২০১৮ইং তারিখের এই বদলি আদেশের মাধ্যমে সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামানকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এবং তার স্থলে মো: আকরাম-আল-হোসেনকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। যিনি ইতোপূর্বে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে (বিপিসি) কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। সবার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়, তা হলো আসিফ-উজ-জামান ডিপিই’র সাবেক ডিজি আবু হেনা মোস্তফা কামালের রোষানলের স্বীকার হয়েছেন। এর মাধ্যমে আবু হেনা অবশ্য একটি বার্তা সবার কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন তা হলো যে বা যারাই তার বিরুদ্ধাচরণ করবে অথবা তার অপকর্মে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, সে যত বড় সরকারি কর্মকর্তা হোক না কেন তাকে বদলি, হয়রানিসহ যেকোন উপায়েই শায়েস্তা করা হবে। তাই আবু হেনা ডিজি থাকাকালীন তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখাতো না।

ইতিপূর্বে মিডিয়ায় আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ তার দুর্নীতির সহচরদের নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যাতে আবু হেনার দুর্নীতির ফিরিস্তি তার বিরুদ্ধে করা তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে তুলে ধরা হয়। তার নেতৃত্বে ও বেশকিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রশিদ ফিরোজ, নাসরিন আক্তার, রোকসানা হায়দারসহ আরো কয়েকজনের যোগসাজশে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে একটি কুচক্রীমহল তৈরি হয়। তারা কারণে অকারণে অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকদের হয়রানি করতেন। ভুয়া ট্যুর বা পরিদর্শনের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন।

সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যে। এটি এমনভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, সুবিধাজনক স্থানে প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আবু হেনা নিজের গুণগান গেয়ে সদুপদেশমূলক বই লিখলেও ডিপিইতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমালেচিত ছিলেন নারী কেলেঙ্কারী নিয়ে। নাসরিন আক্তার নামের এক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সাথে তার অবৈধ সম্পের্কের মুখরোচক গল্প আজও ডিপিইতে বলাবলি হয়। জানা যায় তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ও যুগ্ম-সচিবের সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে তিনি এইসব অপকর্ম করেন।

ডিপিই’র সাবেক ডিজি আবু হেনার এসব অপকর্ম তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসলেও ওই সময় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে চলতেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সাবেক ডিজি আবু হেনা মোস্তফা কামাল নিজেকে শিক্ষা উন্নয়নের বাতিঘর হিসেবে দাবি করলেও তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের শেষ নেই। অদক্ষ, অসাধু, চাটুকার, নারীদের সাথে অবাধে মেলামেশা, সিন্ডিকেট তৈরিসহ দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। অফিস শেষেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে অফিসে একান্তে সময় কাটাতেন তিনি। ভুলে ভরা নি¤œমানের কাগজ দিয়ে নিজ নামে উপদেশমূলক বই ছাপিয়ে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের কাছে জোর করে বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। তিনি একই দিনে একই উপজেলা একাধিকবার ভ্রমণ দেখিয়ে ডাবল টিএ/ডিএ গ্রহণ করেছেন। এভাবে তিনি বহুবার ডাবল/ট্রিপল টিএ/ডিএ গ্রহণ করেছেন। তদন্তে তার এসব অপকর্মের সত্যতা মিলে। তিনি ২৭/২/১৫ইং ও ২৮/২/১৫ইং তারিখে পরপর দুই দিন পিটিআই কক্সবাজার ভ্রমণ করে সম্মানী ও দুইটি টিএ/ডিএ উত্তোলন করেন। তিনি ২৫/৬/১৫ইং তারিখে পিটিআই কক্সবাজার ও ২৬/০৬/১৫ইং তারিখে ডিডি অফিস চট্টগ্রাম ভ্রমণ করে সম্মানি ও দুইটি টিএ/ডিএ উত্তোলন করেন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা থাকলেও ক্ষমতার দাপটে তিনি ফাইল ধামাচাপা দিয়ে তদন্তের কর্যক্রম স্থগিত করেন।

মন্ত্রীর রেফারেন্স দিয়ে ইউইও/ডিপিইও শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে বদলি করেন। বিভিন্ন স্থানে তার ঘনিষ্ঠ কিছু মহিলা শিক্ষক ছিল। জানা যায়, এইসব শিক্ষিকাদের বাসায়ও তার গোপন যাতায়াত ছিল।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের জন্য নির্মাণাধীন ভবনটির কাজ পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দিয়ে কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। টেকনিক্যাল কমিটিকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন ধরণের অফিস সারঞ্জাম যেমন: কম্পিউটার, প্রিন্টার ইত্যাদি ক্রয়েও প্রভাব বিস্তার করে প্রচুর অর্থ লুট করেছেন। আরেক দুর্নীতবাজ নারী কর্মকর্তার সাথে তিনি চীন ভ্রমণ করেছেন। তাদের নামে নানারকম মুখরোচক কথা শোনা যায়। তার অদক্ষতার জন্য পিইডিপি-৪ থেকে অনেক দাতা সংস্থা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক ক্ষতি হয়। চরিত্রহীন, নোংরা মানসিকতার অধিকারী, দুর্নীতিবাজ এই ডিজি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল ডিজি থাকাকালীণ বেতন বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের ডাকা অনশন কর্মসূচি ছিল একটি বড় স্পর্শকাতর ইস্যু। শিক্ষকরা দিনের পর দিন লাগাতার আন্দোলন করেছিলেন। তারা ক্লাস, পরীক্ষা বর্জনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছিলেন। ফলে সেসময় দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ছিল।

প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহারে তাদের সাথে সমঝোতার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে তৎকালীন ডিজি আবু হেনা মোস্তফা কামালকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা পালনে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। উল্টো তার অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে শিক্ষকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের পরিবর্তে তা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছিল। পরে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ও শিক্ষকদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে আন্দোলন স্থগিত করা হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তাদের বছরে অন্তত ১৪ ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কিন্তু নিয়মানুযায়ী প্রশিক্ষণ না দিয়ে এর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাটের অভিযোগ পওয়া গিয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার আমলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কেনাকাটায় চলে হরিলুট। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপোযোগী করার জন্য সরকার সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ ল্যাপটপ দেয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল।

এর জন্য পর্যাপ্ত অর্থও বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে কয়েক হাজার স্কুলে ল্যাপটপসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দেয়া হয়। কিন্তু, সরেজমিনে দেখা যায়, সরবরাহকৃত অধিকাংশ ল্যাপটপেই নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়েছে। এবং এতে পাইরেডেট বা ‘জাল’ সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। হালনাগাদ মডেলের অর্থে কেনা হয়েছিল পুরনো মডেলের ল্যাপটপ। ফলে নিম্নমানের ল্যাপটপগুলোর অধিকাংশই অল্পসময়ের ব্যবধানে ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে ওই সময়ে ‘ডিপিই’ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতে বুঝা যায়, সাবেক ডিজি আবু হেনাসহ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করার নামে কোটি কোটি টাকা নিজেদের পকেটে পুরেছেন।

তার আমলে প্রাথমিক স্কুলের জন্য আসবাবপত্র কেনার টেন্ডারেও সর্বনিন্ম দরদাতার পরিবর্তে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সর্বনিন্ম দরদাতার পরিবর্তে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেয়ার বিষয়টি বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক ডিপিই’র কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। কিন্তু ডিপিই এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংককে সদুত্তোর দিতে পারে নি। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা গিয়েছে।

এতো দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনার সাথে জড়িত থাকা সত্ত্বেও আবু হেনা মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। উল্টো তাকে প্রমোশন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। তিনি বর্তমানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে কর্মরত আছেন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *