দুর্নীতির জালে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ

স্টাফ রিপোর্টার,

লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর : দুর্নীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ-বেবিচক। বিভিন্ন পর্যায়ের টেন্ডার, কেনাকাটা, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কাজের নামে চলছে পুকুরচুরি। এই অনিয়ম-দুর্নীতির নেপথ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ঠিকাদার ও ট্রেড ইউনিয়নের কর্তাব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা গিলে খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটিকে। চলছে সরকারি অর্থের হরিলুট।

প্রতিষ্ঠানটির কোন কাজেই এ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বাইরের অন্য কারো প্রবেশের সুযোগ নেই। অভিযোগ রয়েছে, এই অনিয়মের ইন্ধন যুগিয়েছিলেন বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. নাইম হাসান ও প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীসহ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। উল্লেখ্য এয়ার ভাইস মার্শাল মো. নাইম হাসান ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বেবিচকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

গত ১৮ জুন তাকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে প্রত্যাবর্তন করা হয়। কিন্ত সিন্ডিকেটটির তৎপরতা এখনো অব্যাহত আছে, এমন তথ্য উঠে এসেছে খোদ মন্ত্রণালয়ের তদন্তেই।

বাংলাদেশ বিমান ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন গত ৩ মার্চ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পেশ করে। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ বিমান ও বেবিচকের মোট ১৯ খাতে দুর্নীতির সন্ধান পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ১১টিই বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের। দুদকের এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। তারই প্রেক্ষিতে পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষে ব্যাপক দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে বেবিচকের দুর্নীতির সিন্ডিকেট অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও বাধা দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

গত বছর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কার্গো বিমানের পণ্য আউট ইয়ার্ডে ৭০০ বর্গফুট জায়গা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। ইতিপূর্বে যে কোর্গো সেড ছিল তাতে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। অনেক মালামাল বাইরে রাখায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বিদ্যমান সেডটি সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন। কিন্তু বেবিচকের দুর্নীতিবাজ চক্রটি একে কেন্দ্র করেই লুটপাটের পরিকল্পনা আঁটে। সংস্থাটির প্রকৌশলী শাখা (১) সেড সম্প্রসারণ কাজের জন্য ৪ কোটি টাকা প্রাক্কলন তৈরি করে। তবে ওই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এ কাজে প্রাক্কলনের অর্থ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপর চাপ দিতে থাকে। এতে প্রকৌশলী শাখা (১) রাজী না হওয়ায় প্রকৌশল শাখা (২) থেকে ৪ কোটি টাকার কাজে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন তৈরি করা হয়।
উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে নামেমাত্র দরপত্র- এলটিএম এর মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দেয়া হয়। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যাতে যেতে না হয় এ জন্য কাজটির প্রত্যেকটিকে ৩ কোটি টাকা করে চারটি অংশে ভাগ করা হয়। আর চারটি অংশের কাজই দেয়া হয় একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।

উল্লেখ্য, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী শতকরা একশ’ ভাগ কাজই ই-জিপির মাধ্যমে হওয়ার কথা। কিন্তু বেবিচক কর্তৃপক্ষ সেই নিদের্শনা মানছে না। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে বেবিচক ৪৮১টি কাজের দরপত্রের আহবান করে। তারমধ্যে মাত্র মধ্যে ১৪৪টি দরপত্র ই-জিপির মাধ্যমে হয়। ৩৩৭ টি দরপত্র হয় ইজিপি ছাড়া অর্থাৎ ম্যানুয়্যালি। মাত্র ১০১টি ওটিএম অর্থাৎ উন্মুক্ত দরপদ্ধতিতে হয়। অন্যদিকে ৩৮০টি হয় এলটিএম অর্থ্যাৎ সীমিত দর পদ্ধতিতে।

সূত্র জানায়, কার্গো আউট ইয়ার্ডের ওই সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহার করা হয় পুরাতন স্টিলের পাত এবং পাতলা ছাউনি। অভিযোগ উঠেছে, ৪ কোটি টাকার কাজকে ১২ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হলেও চার কোটি টাকাও খরচ করা হয়নি। প্রায় ৮ কোটি টাকাই ভাগবাটোয়ারা হয়েছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মধ্যে। পুরো কাজের প্রাক্কলনে দরজা জানালার ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা ছিল। অথচ দরজা জানালার কোনো কাজই করা হয়নি। এছাড়া নির্মাণের অন্যান্য কাজ করা হয়েছে অত্যন্ত নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে।

শুধু সেড নির্মাণই নয়, এভাবে প্রত্যেকটি কাজে সরকারি অর্থের হরিলুট চলছে সিভিল এভিয়েশনে।
সিন্ডিকেট নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য তাদের পছন্দসই প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিয়োগ করে কার্যাদেশ দেয়। এসব ফার্ম দরপত্রের স্পেসিফিকেশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এমন ভাবে নির্ধারণ করে, যাতে পছন্দেসই কোম্পনি কাজ পায়। প্রাক্কলন মূল্য প্রকৃত মূলের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয় ।

জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শুরু হওয়ার পর এই দুর্নীতিবাজ চক্রটি অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তদন্ত থামানোর জন্য তারা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক তদবির করছে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সহযোগিতা তো করছেই না, উল্টো নানাভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিশ্বাস বিকাশ গোস্বামীর সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় জানার পর ফোনটি কেটে দেন। পরে অনেকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বেবিচকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ মহলও নড়েচড়ে বসেছে। সংস্থাটির সব দুর্নীতি খুঁজে বের করে তদন্ত করার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে। আরও বলা হয়, এই দুনীর্তির সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আইনের আয়োতায় এনে কঠোর শান্তি প্রদান করা হবে বিন্দুমাত্র ছাড়া দেয়া হবে না। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের এই অবস্থানে বেবিচক-এর দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায় কি না সেটিই এখন দেখার বিষয়।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *