রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কুঋণ সাড়ে ৪৯ হাজার কোটি টাকা

ভূইয়া আসাদুজ্জামান,

লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর : ঋণ খেলাপিদের পুনঃতফসিল ও বিশেষ সুবিধা দেয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণ খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে। ভালো ও নিয়মিত গ্রাহকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে বাড়ছে মন্দ বা কুঋণের পরিমাণ।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে জুন শেষে মন্দ বা কুঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৫০৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপিদের ঋণের পুনঃতফসিল ও বিশেষ সুবিধা দেয়া ছিল সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। এই সুযোগ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করছেন না খেলাপিরা। নতুন ঋণ গ্রহিতারাও এতে ‘সংক্রমিত’ হচ্ছেন। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি মন্দ ঋণের পরিমাণও বাড়ছে, যা দিন দিন ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করে তুলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ১ লাখ ৭০ হাজার ১৭৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি (শ্রেণিকৃত) ঋণের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। মন্দ বা কুঋণের পরিমাণ ৪৯ হাজার ৫০৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা; যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ০৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দেওয়াটা যে ঠিক ছিল না, সেটি এখন স্পষ্ট হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়াটাই ছিল সরকারের একটা ভুল সিদ্ধান্ত। বারবার পুনঃ তফসিলের সুযোগ ও বিশেষ সুবিধা দেয়ায় খেলাপিরা ঋণ পরিশোধবিমুখ হয়ে পড়ছে। তারা মনে করছে, সরকার হয়তো তাদের আরো নতুন কোনো সুবিধা দিতে পারে। এতে তারা ঋণ পরিশোধ না করার বিষয়ে আরও উৎসাহ পাচ্ছেন।’

মন্দ ঋণের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ ভালো গ্রাহক ও নতুন ঋণগ্রহিতাদের নিয়মিত ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত করছে বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর। বলেন, ‘যারা নতুন ঋণ নিয়েছেন তারা ভাবছেন, পুরনো ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তো সুদ কমায়নি। বরং ঋণ নিয়ে আমরা ভোগান্তির শিকার। আমরা কেন নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করব!’

ঋণখেলাপি বা মন্দ ঋণ বাড়ার পেছনে ব্যাংক পরিচালনায় স্বাধীনতা ও পেশাদারির ঘাটতি দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। তিনি বলেন, ‘পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা রয়েছে।

ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও স্বাধীনভাবে কাজ করছে না।’

পেশাগতভাবে ব্যাংকগুলো সঠিক পথে চলছে না উল্লেখ করে সাবেক ডেপুটি গভর্নর বলেন, ‘এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। তাই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে মন্দমানের ঋণের পরিমাণও বাড়ছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, সরকারি ছয় ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের- ২০ হাজার ৯৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ১৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ সোনালী ব্যাংকের, যার পরিমাণ ১২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর প্রায় ২৭ শতাংশ বা ১১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা মন্দ ঋণ। প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ সোনালী ব্যাংকের জুন শেষে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৪২ কোটি ২০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মন্দ ও খেলাপি ঋণে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বেসিক ব্যাংক। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে মন্দ ঋণের পরিমাণ ৫৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

চলতি বছরের জুন শেষে বেসিক ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৯ হাজার ১১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা; যার ৮ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা মন্দ ঋণ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতিও সবচেয়ে বেশি- ৩ হাজার ৭৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

ভালো নেই বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডও (বিডিবিএল)। ব্যাংকটির বিতরণ করা ১ হাজার ৫৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা ৮৯০ কোটি টাকাই খেলাপি। এর মধ্যে কুঋণ ৫৩ শতাংশ বা ৮৫১ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

আলোচ্য সময়ে রূপালী ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ২৪ হাজার ৯৮৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকার ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, যার ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ বা ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা মন্দমানের ঋণ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৮২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

এ সময়ে অগ্রণী ব্যাংক ৩৮ হাজার ৩৭০ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর ৬ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা বা ১৬ দশমকি ৩৪ শতাংশ খেলাপি ঋণ এবং ১৫ শতাংশ বা ৫ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা কুঋণ। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৫২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নি¤œমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়।

খেলাপি ঋণ বাড়লে এবং সেই অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। আর প্রভিশন রাখতে গিয়ে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে যায়, যার প্রভাব পড়ে ব্যাংকের মুনাফায়।

সম্প্রতি সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী এক বছরের বেশি অনাদায়ী ঋণ মন্দ ঋণ হয়। আগে ৯ মাসের বেশি অনাদায়ী ঋণ মন্দ হিসেবে বিবেচিত হতো।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *