জেলের বাইরে সংশোধনের সুযোগ পাচ্ছে দণ্ডিতরা
স্টাফ রিপোর্টার/লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর
রাজশাহীর পবা থানার চৌবাড়িয়া গ্রামের আঙ্গুরা ও তার স্বামীকে নিজ সম্পত্তি থেকে বেদখল করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় প্রতিবেশী জামিরুলসহ চার জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন ঐ নারী। মামলায় জামিরুলকে দেড় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্য আসামিদের ছয় মাসের দণ্ড দেন রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলাম। রায় ঘোষণার পর আসামিরা অনুতপ্ত হয়ে আবেদন করলে দণ্ড স্থগিত করে তাদের শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্য প্রবেশনে পাঠায় আদালত।
শুধু জামিরুলই নন, রড দিয়ে পিটিয়ে এক ব্যক্তিকে জখমের মামলায় ছয় মাসের সাজাপ্রাপ্ত রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মো. ইয়াসিন আলীকেও প্রবেশনে পাঠায় একই আদালত। প্রথমবার অপরাধ করে প্রবেশনে গিয়ে শর্তসমূহ ভঙ্গ না করায় এক বছর পর দুটি মামলার আসামিদের সাজার দায় থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত। ফলে সাজাভোগ না করেই জেলের বাইরে থেকে নিজেদের সংশোধন করে নেন দণ্ডিতরা।
শুধু রাজশাহীতে নয়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালত দণ্ডিত অনেক আসামির আবেদন সাপেক্ষে তাদের প্রবেশনে দিচ্ছে। প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্সের অধীনে এই সুযোগ পাচ্ছেন তারা। ১৯৬০ সালে প্রণীত আইনটি এত দিন সচল না অচল, তা নিয়ে আইন অঙ্গনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কারাগারে আসামির চাপ কমানোর লক্ষ্যে চলতি বছর আইনটির কার্যকর প্রয়োগের জন্য অধস্তন আদালতের বিচারকদের কঠোর নির্দেশনা দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট স্পেশাল কমিটি ফর জুডিশিয়াল রিফর্মসের সুপারিশক্রমে এই নির্দেশনা দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। নির্দেশনায় বলা হয়, কারাগারে অপরাধীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধির পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এই আইনের বিধানাবলি প্রয়োগ অপরিহার্য। কোনো অবস্থাতে এই আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োগ না করা অসদাচরণের শামিল।
আইনে প্রবেশন হচ্ছে কোনো আসামির প্রাপ্ত দণ্ড বা শাস্তি স্থগিত রেখে তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে বাসায় পারিবারিক পরিবেশে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া। তবে দণ্ডিত আসামির বয়স, স্বভাব-চরিত্র, পূর্ব ইতিহাস, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, অপরাধের ধরন বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের। প্রবেশনে দণ্ডিত ব্যক্তির ওপর আরোপিত শর্ত ভঙ্গ করলে দণ্ড ভোগ করতে পাঠানো হয় কারাগারে। এক বছরের কম নয় এবং তিন বছরের বেশি কাউকে প্রবেশনে দেওয়া যাবে না বলে আইনে বলা হয়েছে।
ন্যাশনাল জাস্টিস অডিটে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় ২০১৬ সালে দেশের বিভিন্ন আদালত থেকে ১ হাজার ৭৬৩টি প্রবেশন অর্ডার ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে ১ হাজার ৪৮৬টি, সিএমএম কোর্ট থেকে ১৭৭টি, চৌকি আদালত থেকে ১০০টি ইস্যু করা হয়। তবে প্রবেশন কর্মকর্তারা হাতে পেয়েছেন ১২৬টি অর্ডার। এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, প্রবেশনের উদ্দেশ্য হলো অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা। প্রথমবার অপরাধ করেছে এমন ব্যক্তি দণ্ডিত হয়ে কারাগারে গেলে বড়ো অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে আরো বড়ো অপরাধ সংঘটনের মানসিকতা নিয়ে বের হতে পারেন। সে জন্য এই আইন প্রয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারা এবং বিশেষ আইনে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য হবে না।
যারা সুবিধাভোগী: কোনো পুরুষ লোক দণ্ডবিধির ষষ্ঠ (রাষ্ট্রবিরোধী) ও সপ্তম অধ্যায়ের (সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী-সংক্রান্ত) অপরাধ কিংবা দণ্ডবিধির ২১৬ ক, ৩২৮, ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৮৮, ৩৮৯, ৩৯২, ৩৯৩, ৩৯৭, ৩৯৮, ৩৯৯, ৪০১, ৪৫৫, ৪৫৮ ধারার অপরাধ অথবা মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ ব্যতীত অন্য কোনো দণ্ডনীয় অপরাধে দণ্ডিত হলে এই আইনে সুবিধা পাবেন।
তবে কোনো নারী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দণ্ডে দণ্ডিত অপরাধ ব্যতীত অন্য কোনো দণ্ডনীয় অপরাধে দণ্ডিত হলে অপরাধের প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা, অপরাধীর চরিত্র ইত্যাদি বিবেচনা করে আদালত প্রবেশনে দিতে পারে।
প্রবেশনে থাকা ব্যক্তিরা যা বলেন: রাজশাহীর শামসুল হক বাবু বলেন, ‘সাজা হওয়ার পর খুব অনুতপ্ত হয়েছিলাম। কোর্টকে বলেছিলাম, ভালো হওয়ার সুযোগ চাই। এরপর আমাকে সংশোধনের জন্য প্রবেশনে পাঠানো হয়। প্রবেশনে থেকে আমি নিজেকে সংশোধন করেছি।’ আঙ্গুরা বেগম বলেন, ‘সাজা হওয়ার পর দণ্ডিতদের জেলে না পাঠানোয় মন খারাপ হয়। কিন্তু যখন দেখি আসামিরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আমার সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়েছে, তখন আমি খুব খুশি।’
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইনের প্রয়োগের ফলে মামলা দায়েরের সংখ্যা হ্রাস পাবে। কারণ সাজা ভোগরত আসামিরা আপিল করলে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। আর যার সম্পত্তি বেদখল হয়েছিল, তাকেও সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের মামলা করতে হতো। ফলে সেই প্রক্রিয়ায় না যাওয়ায় মামলা পরিচালনার ব্যয় বহন করতে হচ্ছে না।