ঝুঁকিতে ৪৮ হাজার কোটি টাকার আমানত
ভূইয়া আসাদুজ্জামান /লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :
ঋণ অনিয়মসহ নানা কারণে আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছে দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এদের অবস্থা এতই খারাপ যে, তারা গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। দেশে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোতে গত বছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে।
ব্যাংকে রাখা গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা দিতে আইন থাকলেও প্রচলিত আইনে এসব নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানতের বিপরীতে কোনো সুরক্ষা নেই।
ফলে অনিয়মের কারণে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেলে বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হলে গ্রাহকের আমানত ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
এ অবস্থায় ব্যাংকের পাশাপাশি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের সুরক্ষা দিতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০ সংশোধন করে নতুন খসড়া আইনটির নাম রাখা হয়েছে ‘আমানত সুরক্ষা আইন, ২০১৮’।
এই আইনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান উভয়কেই গ্রাহকের আমানতের বিপরীতে বীমা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
সংশোধিত আইনের ৪ ধারায় (খসড়া) বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, (১) এই আইন প্রবর্তনের তারিখে বিদ্যমান প্রত্যেক তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান উক্ত তারিখ হইতে তহবিল এর সহিত বীমাকৃত বলিয়া গণ্য হইবে, এবং (২) এই আইন প্রবর্তনের পর প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেক তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তহবিল এর সহিত বীমাকৃত হইবে।
’ প্রস্তাবিত আইনের সংশোধন চূড়ান্ত করতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। ওই সভায় আমানতের বিপরীতে করা বীমার প্রিমিয়ামের হার পরিশোধে ব্যর্থ হলে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অরিজিৎ চৌধুরী বলেন, গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা দিতে আগে যে আইনটি ছিল সেটি শুধু ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
কিন্তু এখন নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও আমানত সংগ্রহ করছে। সরকার মনে করছে, ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতেরও সুরক্ষা দেওয়া দরকার। সে কারণে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রচলিত আইনে প্রত্যেক বীমাকৃত ব্যাংক তার আমানতের অংশের ওপর প্রতি বছর শতকরা সাত পয়সা করে তহবিলে প্রিমিয়াম দেয়। সংশোধিত আইনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই প্রিমিয়ামের হার অনির্ধারিত রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সময় সময় যেটি নির্ধারণ করে দেবে সে অনুযায়ী প্রিমিয়াম রাখতে হবে। তহবিলের অর্থ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর পাওনা পরিশোধে এবং এই তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাদে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে না। সংশোধিত আইন অনুযায়ী কোনো কারণে দেশে কার্যরত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও (অবসায়ন) আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে এই আইনের আওতায়।
আমানতকারীদের জমা করা আমানতের মধ্যে বীমার সমপরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। সরকারের অনুমোদন নিয়ে পর্যায়ক্রমে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক তহবিল থেকে দেবে। অবসায়নের ৯০ দিনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করা হবে। একাধিক হিসাব থাকলে একত্রিত করে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা তহবিল থেকে দেওয়া হবে। তবে তহবিলে আমানতকারীর পাওনার তুলনায় কম অর্থ থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংক রেটে অর্থ কর্জ করে তা পরিশোধ করবে সরকার। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের কোনো পাওনা থাকলে তা-ও সমন্বয় করা হবে।
দুরবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান : সংশ্লিষ্টরা জানান, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাইরে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ, নতুন প্রকল্প স্থাপনে অংশগ্রহণ, ইক্যুইটি ফিন্যান্স, লিজ ফিন্যান্স এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের লক্ষ্যে মূলত দেশে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়ী আমানত গ্রহণ করতে পারে না। জনগণের কাছ থেকে এরা শুধু দীর্ঘমেয়াদি আমানত বা স্থায়ী আমানত (এফডিআর) সংগ্রহ করতে পারে। আর এ সুযোগে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ঋণ বা লিজ না দিয়ে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা নামে-বেনামে নিজেরাই ঋণ নিয়ে যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানের ৬০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত ঋণ নিজেরাই গ্রহণ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে উঠে আসে, পিপলস লিজিং থেকে বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক পরিচালকরা তুলে নিয়েছেন। ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৫ সালে ৫ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে চরম সংকটে পড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে খারাপ পর্যায়ে আনার পেছনে অভিযুক্ত সাবেক আট পরিচালক ও তিন কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ এবং সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে আমানতকারীদের জমানো ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা কোন উপায়ে ফেরত দেওয়া যায় তা নিয়ে কাজ চলছে। একই কারণে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) অবসায়ন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। লিজিং কোম্পানি নামে পরিচিত আরও নয়টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। এদের মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
নাজুক অবস্থায় থাকা এমন ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রেড জোন বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া হলুদ তালিকায় রয়েছে আরও ১৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবিধান সঠিকভাবে মানেন না। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বিপদে পড়েছে।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটের কারণে আমানত ফেরত দিতেও পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দ্রুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা নয়তো আর্থিক খাতে দুরবস্থা দিনদিন আরও বাড়বে।