ইউজিসির সুবিধাভোগীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

ইউজিসির সুবিধাভোগীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

মোক্তার / লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :

বেসরকারি কুইন্স ইউনিভার্সিটি ১০ কোটি টাকায় ‘বিক্রি’ বা ‘হস্তান্তর’ বিতর্কের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অন্তত চার কর্মকর্তা সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে দুই কর্মকর্তা ‘আর্থিক’ সুবিধা নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। আর দেশে থাকা অন্য দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও সে বিষয়ে ইউজিসির এখনও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। অভিযোগ থাকার পরও ইউজিসির সদস্য ড. দিল আফরোজা বেগমের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি। এসব কারণে অনুমতি পেয়েও নতুন করে শুরু হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম।

ইউজিসি ও সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কুইন্স ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ড. হামিদা বানু শোভা। ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন দেয় সরকার। ১৯৯৭ সালে এখানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। তবে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার এসে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১২ সালের ২৪ জুন উচ্চ আদালতের রায়ে শিক্ষা কার্যক্রম আবারও পরিচালনার অনুমতি পান হামিদা বানু শোভা।

২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর এ সময়ই শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ঘিরে একের পর এক নাটক। এ সময় উদ্যোক্তা ড. হামিদা বানু শোভা ১০ কোটি টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘বিক্রি বা হস্তান্তর’ করেছেন- ইউজিসির কাছে এমন নথি উপস্থাপন করে আরেকটি পক্ষ। ইউজিসি তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শন করে প্রতিবেদনও জমা দেয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘বিক্রি বা হস্তান্তরের’ অভিযোগ অস্বীকার করে হামিদা বানু শোভা দাবি করেন, ‘হস্তান্তর নয়, বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলের চেষ্টা করা হয়েছিল। আর তাতে দখলকারীদের সহযোগিতা করেছেন ইউজিসির কর্মকর্তারাই।’ এরপর ইউজিসির পক্ষ থেকে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি পাওয়ার পর এটির পরিচালনা ও মালিকানা বদল নিয়ে ভেতরে ভেতরে অনেক ঘটনা ঘটে। ইউজিসির সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্যোক্তা ড. হামিদা বানু শোভা হলেও এ সময় রাজধানীর সেগুনবাগিচার এনজি জান্নাতি খোদা নামে এক নারী বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিকানা দাবি করেন। ১০ কোটি টাকায় হামিদা বানুর কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বত্ব কিনে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয় তার পক্ষ থেকে। এই হস্তান্তর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর কুইন্স ইউনিভার্সিটির নামে এর ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার নাছিমা আক্তার স্বাক্ষরিত একটি আবেদন জমা পড়ে ইউজিসিতে।

আবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক ভবন পূর্ব শেওড়াপাড়ার ৯৭১ নম্বর হোল্ডিংসের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় ৬ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে এবং মূল ক্যাম্পাস ও একাডেমিক ভবন পূর্ব শেওড়াপাড়ার আরেকটি ভবনের অষ্টম, নবম ও দশম তলায় ২১ হাজার বর্গফুট ভাড়া নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে। এই ঠিকানা পরিদর্শনসহ ওই আবেদনে www.queensuniversity.ac ওয়েবসাইটের সব তথ্য ইউজিসির ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানানো হয়।

এই আবেদনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও অবকাঠামো নির্মাণ সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য ইউজিসি একটি কমিটি গঠন করে। দুই সদস্যের এই কমিটির প্রধান করা হয় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগমকে। সদস্য সচিব ছিলেন ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের ওই সময়ের সহকারী পরিচালক মুর্শেদ রায়হান। ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে।

২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি দাখিল করা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বনানীর ঠিকানা বাদ দিয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার নাছিমা আক্তারের আবেদনের ৯৭১, পূর্ব শেওড়াপাড়ার ঠিকানায় সরেজমিন তদন্ত করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিবেদনের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল উদ্যোক্তা হামিদা বানু শোভার নাম ছিল না। এ অবস্থায় ভবন নির্মাণকালে বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল ঠিকানাও অনুসন্ধান করা হয়নি। যাচাই করা হয়নি উদ্যোক্তার ঠিকানাও। নতুন ঠিকানায় বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে যাওয়া যে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার অংশ তাও উল্লেখ করা হয়নি এ প্রতিবেদনে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কী প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হবে তারও উল্লেখ নেই ওই প্রতিবেদনে।

এনজি জান্নাতি খোদা বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজেদের দাবি করার এক মাস পর ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হামিদা বানু শোভা ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আবেদন করেন। আবেদনে তিনি বলেন, ‘যেহেতু বিশ্ববিদ্যলয়টি অনেক দিন বন্ধ ছিল, সেহেতু নতুন ভবনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় প্রস্তুত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি।’ আবেদনে হামিদা বানু শোভা রাজধানীর বনানীর হাউস-৪৩/ই, রোড-১৭/এ ঠিকানা উল্লেখ করেন।

দুই সদস্যের কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি কুইন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয় ইউজিসি। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইট (www.queensuniversity.ac) ইউজিসির ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া হাতে নেয়। তবে ওয়েবসাইটটি খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। ইউজিসির কর্মকর্তারাই অনলাইনে খুঁজে পান কুইন্স ইউনিভার্সিটির নামে দুটি ওয়েবসাইট। অপর ওয়েবসাইটের ঠিকানা (www.queensuniversity.edu.bd)। আর এই ওয়েবসাইটের তথ্যে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্যোক্তা হামিদা বানু। ফলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে তদন্ত করতে বাধ্য হয় ইউজিসি।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *