পিলখানা হত্যা মামলা রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা

কোর্ট রিপোর্টার / লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন বেঞ্চের একজন বিচারপতি। এ মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায় (ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর) আজ বুধবার প্রকাশ করেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ হাইকোর্ট বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এগুলোম হলো:

১. (ক) বাংলাদেশ রাইফেলসের নিরাপত্তা বিষয় ক ইউনিট RSU বিজিবির মেধাবী, সৎ ও চৌকশ সদস্যের সমন্বয়ে নুতনভাবে ঢেলে সাজানো। ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটনার সময়ে দায়িত্বে থাকা RSU এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

(খ) ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালকের দরবারে সশস্ত্র আক্রমণ এবং পিলখানায় মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পূর্বাভাস সংগ্রহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২. (ক) প্রধানমন্ত্রী ২৪/০২/২০০৯ তারিখে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলসের কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেছেন, অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা বাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীদের বাহ্যিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও ভেতরে অন্তঃসার শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্ক করা।

(খ) বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ এবং প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্ত্বেও তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণ না নিয়ে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য সংশ্লিষ্টদের মনোযোগী ও সতর্ক হওয়া।

৩. (ক) মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মেধাবী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দক্ষ, তড়িৎ ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী, উপযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিজিবির মহাপরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাকে প্রেষণে নিয়োগের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

(খ) বিজিবির অফিসারসহ সব পদের সদস্যদের মানবিক গুণাবলি, দায়িত্ব, কর্তব্য, বিভাগীয় আইন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ।

৪. (ক) সামরিক/বেসামরিক সব শ্রেণির কর্মকর্তাদের ব্রিটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সবাইকে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশ প্রেমের সঙ্গে কাজ করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

(খ) ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সমভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামে পেশা, পদবি, সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংবিধানে উল্লিখিত মূলনীতি অনুসরণ করে সবার প্রতি মানবিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতায় বাহিনীকে গড়ে তোলা।

৫. (ক) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিজিবিসহ অধীনস্থ সব বাহিনীর সদস্যদের সুবিধা/অসুবিধা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

(খ) বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির আগেই কর্তৃপক্ষকে আইনসম্মত ও সম্মানজনক উপায়ে তার সমাধান খুঁজে বের করা।

৬. (ক) বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে চাকরি বিধি মতে, মর্যাদার পার্থক্য যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং সবাইকে সংবিধানসম্মত উপায়ে আইনানুগভাবে সম্মানের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের চাকরি করার সুযোগ সৃষ্টি করা।

(খ) বিজিবির সদস্যদের পদোন্নতি, বেতন, ভাতা, রেশন, ছুটি, আবাসিক সমস্যা, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের সুবিধাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা দ্রুত সমাধানে মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৭. (ক) আহনানুগ কোনো বাধা না থাকলে অন্যান্য বাহিনীর ন্যায় বিজিবির সদস্যদের জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

(খ) বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের প্রতি সম-আচরণ করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার কর্তৃক অধন্তনদের প্রতি আত্মমর্যাদা হানিকর যে কোনও আচরণ থেকে বিরত থাকা। কারণ, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।

৮. (ক) ২৫/২৬ ফেব্রুয়াারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় নিহত সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।

(খ) সেনা কর্মকর্তাসহ নিহতদের সন্তান বা পরিবারের উপযুক্ত সদস্যদের আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিধানে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

(গ) সামরিক কর্মকর্তাসহ নিহতদের সম্মানে পিলখানাসহ দেশের সব সেনানিবাস, বিজিবির সব সেক্টর হেডকোয়ার্টারে নামফলক নির্মাণ করা।

৯. (ক) পুনর্গঠিত বিজিবি সংবিধান ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে দেশের সীমান্ত রক্ষাসহ তাদেরও অর্পিত সব দায়িত্ব পেশাদার বাহিনী হিসেবে দেশপ্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে পালনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিজিবির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা।

(খ) দেশের সীমান্তরক্ষী হিসেবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রাথমিক নিরাপত্তা বাহিনীর (First Defence Force) দায়িত্বে থাকা বিজিবিকে শক্তিশালী বাহিনী রূপে গড়ে তোলার কার্যকরী পদক্ষপ গ্রহণ করা।

১০. (ক) সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে অপারেশন ডাল ভাতের ন্যায় অন্য কোনো আর্থিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত পরিহার করা। এতে আর্থিক লেনদেন ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের অহেতুক বিভেদ ও নৈতিক স্খলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ রাইফেলসের ক্ষেত্রে ‘অপারেশন ডালভাত’ উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

(খ) পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ উদঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য জনস্বার্থে সরকার প্রয়োজন মনে করলে আইনানুগভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

১১. (ক) সমাজের সব স্তরে নৈতিকতা পুনরুদ্ধার ও জাতি গঠনের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় বাধ্যতামূলক নীতিশাস্ত্র শিক্ষাদান অতি জরুরি। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরে অসম প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নীতিশাস্ত্রের অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক হওয়া অপরিহার্য।

খ) রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বসবাস উপযোগী উন্নত ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুশাসনে শিশুদের চরিত্র গঠনের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিশুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আজ বলেছেন, পিলখানা হত্যা মামলায় তিন বিচারপতি একমত হয়ে রায় দিয়েছেন। যারা হাইকোর্টে খালাস পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে আপিল করা হবে । এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, মোট ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায় ছিলো এটি। তিনজন বিচারপতি ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। কিন্তু তিন জনই আলাদা আলাদা রায় দিয়েছেন।

২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ওই রায় ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারের দ্বিতীয় ধাপ শেষ হলো। এখন সংক্ষুব্ধরা আইনানুযায়ী আপিল বিভাগে যেতে পারবেন।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আক্তারুজ্জামান পিলখানা হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। বেকসুর খালাস দেন ২৭৮ জনকে। পরে এটি ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হিসেবে হাইকোর্টে আসে।

আসামিরা বিচারিক আদালতের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন। যার পূর্ণাঙ্গ রায় আজ প্রকাশ হয়েছে।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদর দফতর পিলখানায় জওয়ানদের বিদ্রোহ থেকে হত্যাকাণ্ড চলে। বিডিআরের মহাপরিচালক, সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন মারা যান।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *