সচিবের বৈঠক বিষয়, খতিয়ে দেখছেন আইনমন্ত্রী
শাহ্ সাকিব / লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন এবং সংসদ বিভাগের সচিব নরেন দাসের একটি সাম্প্রতিক বৈঠক নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বিতর্ক উঠেছে। প্রশ্ন তুলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেই। তিনি বলেছেন, তাকে না জানিয়ে বৈঠকটি হয়েছে। এর কারণ কী তা তিনি খতিয়ে দেখতে চান।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত ১২ জানুয়ারি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের উপ-হাইকমিশনার বিশ্বদীপ দে’র সঙ্গে বৈঠকটি করেন আইন ও সংসদ সচিব। রাজধানীর অভিজাত একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালাচ্ছেন আইনমন্ত্রী।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত ১২ জানুয়ারি সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাস ভারতীয় হাইকমিশনের উপ-হাইকমিশনার বিশ্বদীপ দে’র সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতীয় হাইকমিশন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি তারা বিষয়টি জানেন না বলেও উল্লেখ করেন। তবে বৈঠকের পর হাইকমিশন থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে, মন্ত্রণালয়ের আইন ও সংসদ বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল সংসদ বিষয়ক বিভাগে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ভারতীয় পার্লামেন্টের ব্যুরো অব পার্লামেন্টারি স্টাডিজে প্রতি বছর প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
কিন্তু সে বৈঠকে স্বয়ং সচিব কেন? আর মন্ত্রী কেনো সে বৈঠক সম্পর্কে আগে কিছুই জানতে পারেন নি? এমন সব প্রশ্নকে ঘিরেই পক্ষে বিপক্ষে নানা বিতর্ক চলছে মন্ত্রণালয়ে।
সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা র্যাংকিংয়ে তৃতীয় স্তরের পদ মর্যাদার অন্য দেশের কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের হেতু কী হতে পারে? সে কারণেই এই বৈঠককে সন্দেহের চোখে দেখছেন অনেকেই। সচিব নরেন দাসের বিগত দিনের কিছু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিষয়টি মেলানোরও চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সারাবাংলা’কে বলেন, ‘সচিব নরেন দাসের গত ১২ জানুয়ারির বৈঠক সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তবে কী কারণে ওই বৈঠক হয়েছিল, আমি সেটা খতিয়ে দেখছি’।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘সচিব যে ধরণের দায়িত্বে আছেন, সেই জায়গা থেকে এমন বৈঠক করতে পারেন না’।
সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাস এর মন্তব্য জানার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে একটি সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় ওই বৈঠকে সচিব নরেন দাসের সঙ্গে একই বিভাগের যুগ্ম-সচিব কাজী আরিফুজ্জামানও ছিলেন।
যুগ্ম-সচিব কাজী আরিফুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভারতীয় হাইকমিশনের উপ-হাইকমিশনার বিশ্বদীপ দে গত ১২ জানুয়ারি সচিব নরেন দাস এবং আমাকে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাও হোটেলে নৈশ ভোজের দাওয়াত দেন। সেখানে তার সঙ্গে লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের ভারতীয় পার্লামেন্টের ব্যুরো অব পার্লামেন্টারি স্টাডিজে প্রতি বছর প্রশিক্ষণে পাঠানো যায় কী না? তা নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি জানান, অতীতে এই সুযোগ থাকলেও পরে তা বন্ধ রাখা হয়। সচিব ও যুগ্ম-সচিব তা ফের চালু করার জন্যই বৈঠকে জোর দেন।
কাজী আরিফুজ্জামান বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরধরে ভারতীয় পার্লামেন্টে লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং সংক্রান্ত প্রোগামে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের কর্মকর্তারা সুযোগ পাচ্ছে না। তাই যাতে সুযোগটা অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে ওইদিন ভারতীয় প্রতিনিধিকে অনুরোধ করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘নৈশ ভোজের ওই আয়োজনটি ছিল মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা মাত্র। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় ভারতীয় হাইকমিশনার এই বিষয়ে চিঠি দিলে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকারি পর্যায়ে নেওয়া যেতে পারে মর্মে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের পক্ষ থেকে ভারতীয় প্রতিনিধিকে জানান হয়।
যুগ্ম-সচিব আরও জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই ভারতীয় দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং নৈশভোজটি প্যান প্যাসিফিক সোনারগাও হোটেলের উন্মুক্ত রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত হয়।
তবে এই যুগ্মসচিব দাবি করেন, ওই নৈশভোজে আরো কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ওই কয়েকজন বলতে সরকারের স্পর্শকাতর একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেন তিনি। সেখানে তারা তাদের চলমান প্রশিক্ষণ, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসহ একাধিক বিষয় ছাড়াও বাংলাদেশে বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার বিষয়েও আলোচনা করেন বলে জানান কাজী আরিফুজ্জামান।
তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ও উল্লেখিত কর্মকর্তাদের নাম জেনে নিয়ে তাদের সঙ্গেও কথা হয। তারা (সরকারের স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান হওয়াতে নাম উহ্য রাখা হল) জানান, ওইদিন তারা ভারতীয় হাইকমিশনের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেননি এবং ওইদিন লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের কোনো কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তাদের দেখা হয়নি।
এদিকে, মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানাচ্ছে, সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাস আইন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব থাকা কালে তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠান ‘নাইকো’ থেকে উপঢৌকন নেন। ওই সময়ে নাইকো থেকে উপঢৌকন নেয়া একটি ল্যাপটপ মধ্যরাতে তার শ্বশুড়বাড়ি থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা তার উপস্থিতিতেই উদ্ধার করে। কিন্তু এর পরে এই মামলার তদন্তে ল্যাপটপ নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু নরেন দাসের বিরুদ্ধে এর আগে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে তাই গত ১২ জানুয়ারির অনানুষ্ঠানিক বৈঠকটি সন্দেহের সৃষ্টি করে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ১২ জানুয়ারির ওই বৈঠকের পর ১৩ জানুয়ারি ঢাকার ভারতীয় মিশন লেজিসলেটিভ এবং সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাসকে এক চিঠি পাঠায়। এতে লেজিসলেটিভ ড্রাফটিংসহ সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সহায়তা দিতে নয়াদ্দিলি রাজি রয়েছে বলে জানানো হয়। তবে সে জন্য দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষর প্রয়োজন বলেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।