বোহরারাই সম্প্রদায়ের বাংলাদেশ জাতীয় গড়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি
স্টাফ রিপোর্টার / লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :
অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ও ক্রমে বাড়ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৯০৯ ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও এ মাইলফলক অনেক আগেই ছুঁয়েছে দেশে বসবাসরত বোহরা সম্প্রদায়। তাদের মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, প্রায় ৬ হাজার ডলার। বংশ পরম্পরায় ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বোহরা সম্প্রদায়ের প্রায় প্রতিটি পরিবারই স্বাবলম্বী।
উনিশ শতকের শুরুতে ভারতের গুজরাট থেকে বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করে দাউদি বোহরা সম্প্রদায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এ গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা এক হাজারেরও কম, যার সিংহভাগই বাস করেন চট্টগ্রামে। সংখ্যায় নিতান্ত ক্ষুদ্র হলেও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নিভৃতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে এ সম্প্রদায়। শুধু চট্টগ্রামেই ৫০ থেকে ৬০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বোহরাদের। আমদানি বাণিজ্যে যুক্ত বোহরা ব্যবসায়ীদের অর্ধেকেরই পুঁজি শতকোটি টাকার ওপরে। শুধু আমদানি-রফতানি ব্যবসা নয়, শিল্পায়নেও বড় ভূমিকা রেখে চলেছে বোহরারা। তাদের রয়েছে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ। দেশের ইস্পাত খাতের শীর্ষগ্রুপ বিএসআরএম বোহরাদেরই গড়েতোলা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ফার্নিচার ও পলিমারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকারী হাতিম গ্রুপ, আইটি খাতের ইজি গ্রুপ এবং কপার পণ্য প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠান কপারটেক লিমিটেডের উদ্যোক্তাও বোহরা সম্প্রদায়ের। ফকরি অ্যান্ড সন্স বোহরা সম্প্রদায়ের আরেকটি শীর্ষ ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠান।
বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হলেও বোহরা সম্প্রদায় অতিরিক্ত লোভ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যে যুক্ত হয় না। নিজের যতটুকু পুঁজি রয়েছে, সেটি দিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করে। ফলে ঋণ গ্রহণ ও প্রদানের ক্ষেত্রেও রক্ষণশীল বোহরা সম্প্রদায়। তবে নিজ গোত্রের মানুষ বা পিছিয়ে পড়াদের জন্য উল্টো বোহরাদের মনোভাব। সুদ বিহীন ভাবে সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অর্থসহায়তার মাধ্যমে চেষ্টা করে ব্যবসায়িক ভাবে এগিয়ে নিতে।
বোহরাদের স্বাবলম্বী হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জাকাত ফান্ড। প্রতিবছর নিজ গোষ্ঠীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়াপরিবার বা ব্যক্তিকে জাকাতের সমুদয় অর্থবা সম্পদ দিয়ে দেয়া হয়। ওই অর্থ দিয়েপিছিয়ে পড়া ব্যক্তি বা তারপরিবার সম্প্রদায়ের অন্যদের সহায়তায় ব্যবসায় প্রবেশ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রেএ জাকাতের পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক বোহরা ব্যবসায়ী। এছাড়া অর্থের প্রয়োজনে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীদের সহায়তাও দেয়া হয়।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও দেশের অন্য গোষ্ঠীগুলোর চেয়ে এগিয়ে বোহরা সম্প্রদায়। বোহরাদের শতভাগই শিক্ষিত। এ সম্প্রদায়ের ৯০ শতাংশ মানুষই গ্র্যাজুয়েট। পড়াশোনা কিংবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সম্প্রদায়ের অধিক বিত্তবান কিংবা ট্রাস্টের সহায়তা থাকায় পড়াশোনার বিষয়ে কেউই পিছিয়ে পড়ে না।এ সম্প্রদায়ের ১০ জনেরও বেশি প্রকৌশলীও তিনজন ডাক্তার রয়েছেন। যারা পড়াশোনা শেষে নিজে ব্যবসা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কিংবা পৈতৃক ব্যবসারহাল ধরেছেন।
বোহরা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে উচ্চতর পড়াশোনার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু পড়াশোনাশেষে অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরিবর্তে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সবাই। এ সম্প্রদায়ের কেউই কখনো সম্প্রদায় বহির্ভূত জনগোষ্ঠীর মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছে এমন নজির নেই।
সম্প্রদায়টি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সরকারি রেজিস্ট্রেশনকৃত ট্রাস্টটির নাম ‘আঞ্জুমানে তাহেরী ট্রাস্ট’। প্রতি তিন বছর অন্তর এর কমিটি পরিবর্তন হয়।এর প্রধান বা চেয়ারম্যান মুম্বাইয়ের মোহাম্মদ জাফর আলী। মুম্বাইয়ের বোহরা সম্প্রদায়ের পীর সাঈদনা মোফাদ্দেন সাইফুদ্দিন। বর্তমানে ট্রাস্টের সেক্রেটারি হিসেবে আছেন মেসার্স জাফরি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আফতাব হোসাইন।
মোহাম্মদ আফতাব হোসাইন বলেন, বোহরা সম্প্রদায় বিশ্বের যে দেশেই থাকবে সে দেশের আইন, নিয়ম, রাষ্ট্রীয়নীতি ও সামাজিক সংস্কৃতিকে মেনে নিয়েই বসবাস করে। সামাজিকভাবে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘাত কিংবা দ্বন্দ্বে জড়ায়না। পড়াশোনা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাবলম্বী হতে সম্প্রদায়ের সবার সহযোগিতা নেয়াহয়। ফলে কেউই পিছিয়ে পড়ে থাকে না। চাকরির চেয়েও ব্যবসায় সমৃদ্ধিসহ বিধায় শতভাগ শিক্ষিত হয়েও সন্তানরা পারিবারিক ব্যবসায় নিযুক্ত হয়। কেউ কেউ পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কিত নতুন ব্যবসায় প্রবেশ করে।
বোহরা সম্প্রদায় পোশাকের ক্ষেত্রেও নিজেদের স্বকীয়তা ধরে রাখতে খুবইসচেতন। পুরুষরা সাধারণত পাজামা-পাঞ্জাবি পরেন। সবসময় একটি বিশেষ ধরনের টুপি পরেন মাথায়। মহিলারা বোরকা পরেন। টুপি ও বোরকা নিজেরাই তৈরি সেলাই করেন। নারীরা বিশেষ রঙ ওডিজাইনের বোরকা পরলেও ঘরের বাইরে নারীদের মুখমণ্ডল উন্মুক্ত রাখেন। তাদেরবোরকার কাপড় ও রঙ বাংলাদেশের যেকোনো বোরকার চেয়ে আলাদা, যাবোহরা নারীরা বাড়িতে সেলাই করেন।
বিয়ে সংক্রান্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বোহরা সম্প্রদায় খুবই রক্ষণশীল। নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই কেবল বিয়ে হয়। ফলে এসম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রেণীগত বিশুদ্ধতা খুবই প্রবল। নিজ গোত্রের মধ্যে পছন্দের পাত্র বাপাত্রী পাওয়া না গেলে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বিয়েহয় বোহরাদের। এক্ষেত্রে নিজ সম্প্রদায়ের আর্থিকভাবে অসচ্ছল যুবককে বিয়ে করে সচ্ছল করার চেষ্টা থাকে।
বোহরা জনগোষ্ঠীর বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষক, কক্সবাজার ইউনিভার্সিটির উপাচার্যও ইরান-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. আবুল কাশেম বলেন, সব মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রায় একহাজার বোহরা সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। মেমন বা গুজরাটি সম্প্রদায়গুলোর মতোই বোহরা সম্প্রদায়ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাংলাদেশে বসবাস করছে। বর্তমানে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বাস করলেওএখানকার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। নতুন প্রজন্ম পড়াশোনা করলেও শেষপর্যন্ত নিজেদের ব্যবসাই তাদের শেষ গন্তব্য। বোহরাদের কেউ কেউ হার্ডওয়্যার ব্যবসায় প্রথম সারিতে থাকলেও নিজগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়াদের সহযোগিতা করতে নিজেদের ব্যবসায় সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে চায়।এসব কারণে দেশের যেকোনো পেশা বাশ্রেণীর মানুষের চেয়ে বোহরা সম্প্রদায় সম্পদশালী বলে মনে করছেন তিনি।
বোহরা সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধানত কথা বলেন গুজরাটি ভাষায়। তবে সম্প্রদায়ের একাধিক নেতৃস্থানীয় মানুষের ভাষ্য, তাদের মুখের ভাষা গুজরাটি ও অ্যারাবিক ভাষার মিশেলে। এছাড়া হিন্দি, ইংরেজি, বাংলাপ্রভৃতি ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা।
বোহরা সম্প্রদায়ের বসবাস চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায়। জুবিলী রোডেই সবচেয়েবেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের। এছাড়া তারাবসবাস করে গোয়ালপাড়ার সাইফিকলোনি, জুবিলী রোড, আসকার দীঘিরপাড়, জামালখান ও নাসিরাবাদ এলাকায়। সাইফি কলোনি এলাকায় নিজস্ব জমিতেনিজস্ব মসজিদ, সেফিয়া মাদ্রাসা ছাড়াও ৪৫টি পরিবার বসবাস করে। বোহরাদেরপ্রায় ১২০টি পরিবার চট্টগ্রামে, ছয়টি পরিবার খুলনায়, যশোরে এক, সিলেটে এক এবং ঢাকায় প্রায় ৮০ পরিবার বসবাসকরে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনেই চট্টগ্রাম থেকে গেছে ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকায় বসবাসরত বোহরা সম্প্রদায়ের মানুষ।চট্টগ্রামে বসবাসরত বোহরাদের মধ্যে ১০-১৫ পরিবার ছাড়া সবারই নিজস্ব বাড়িও ফ্ল্যাট রয়েছে।