বান্দরবানে করোনা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকায় বিএমএসএ
পার্বত্য এই শহরে শুনশান নিরবতা। পর্যটক মূখর তল্লাটে শূন্যতার চিত্র সবখানে। হাহাকার করছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো থেকে শুরু করে শহরের প্রধান সড়ক। পুরো দেশ যখন আন্তঃযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তখন সাত সকালে কিছু যুবক যুবতী বেড়িয়েছে কাঁধে সিলিন্ডার নিয়ে। কারো হাতে হ্যান্ডমাইক। কারো হাতে লিফলেট । কেউ কেউ বিতরণ করছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এরা সবাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেশের স্বনামধন্য মেডিকেল কলেজগুলোতে অধ্যয়নরত। তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা পাহাড়ের সন্তান। এই আপদকালীন সময়ে সবাই কোয়েরান্টাইনে ব্যস্ত থাকলেও তারা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেত পারে নি। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনায় সারাদেশে ছুটির আমেজ থাকলেও এরা দিন-রাত জেগে মানুষকে সচেতন করার প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের একটি সংগঠন রয়েছে।
বান্দরবান থেকে সারাদেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের এই সংগঠনের নাম বান্দরবান মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএসএ)। চীনের ওহান শহর থেকে কোভিড-১৯ যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তখন থেকেই তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজ নিজ স্থান থেকে সচেতনতামূলক উপদেশগুলো মানুষকে জানিয়ে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে যখন বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করলো, তখন তারা শঙ্কিত হলো। শঙ্কাটা আরো বেশি হলো যখন তারা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারলো, এই ভাইরাস সংক্রমিত হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চল হবে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম। এমন সংবাদ পেয়ে তারা সবাই ফিরে আসে নিজ এলাকাতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় তাদের ফিরে আসাও সহজ হয়েছিল।
সংগঠনটির সভাপতি বেনজীর জাহাঙ্গীর নুয়েল বলেন, কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস যে দেশে প্রভাব বিস্তার করতে যাচ্ছে , তা আমরা আচ করতে পেরেছিলাম। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করি। আমাদের প্রত্যেকের লক্ষ্যই ছিল যেকোন মূল্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের পথকে অবরোদ্ধ করা। ২৪ মার্চ বান্দরবান জেলা পরিষদের আয়োজনে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, যেকোন কাজ করার আগে সেকাজ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং কাজের ধরণ সম্পর্কে প্রত্যেকের সঠিক জ্ঞান থাকা উচিৎ। ২৫ তারিখ থেকে আমরা সরেজমিনে কাজ শুরু করি।
সবার আগে দরকার সচেতনতা। মানুষ যদি সচেতন হয়, তাহলে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব – এ নীতিতে আমরা বান্দরবান শহরে প্রচারণার মাধ্যমে আমাদের কার্যাবলী শুরু করি। পাশাপাশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ, জীবাণুনাশক স্প্রের সাহায্যে বিভিন্ন যানবাহন এবং রাস্তাঘাট জীবাণুমুক্ত করার কার্যক্রম হাতে নেই। আমরা হ্যান্ড মাইকের সাহায্যে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করি। যারা শিক্ষিত, তাদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করার কথাও জানান বিএমএসএ’র সাধারণ সম্পাদক নাজমুস সাকিব চৌধুরী।
২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি শুধু বান্দরবান সদরেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে নি। লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা এবং থানচিতেও তাদের গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান আছে বলে জানান সংগঠনটির প্রচার সম্পাদক ইরফান বিন কায়েস। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম, ঘর বাড়িতে করোনা প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপসহ শারীরিক অসুস্থতায় এই সময় যেসব কাজগুলো করা জরুরী সে সম্পর্কে চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী নির্দেশিকা প্রচার করাটাই তাদের এই প্রচারণার মূল লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেন বিএসএমএ এর সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইয়াসিন আরাফাত আলভি।
৩১ মার্চ পর্যন্ত তাদের এই কার্যক্রম চলমান থাকবে। দেশের ক্রান্তিকালীন সময়ে তাদের এমন উদ্যোগ প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। প্রশংসনীয় এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বান্দরবান সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জন অংশৈ প্রু বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বান্দরবান মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম ইতিবাচক। মানুষ তাদের শেখানো পদ্ধতিগুলো সাদরে গ্রহণ করছে। করোনা মোকাবেলায় সদর হাসপাতালে করোনা ইউনিট খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাত জন আইসোলেশনে রয়েছেন। এছাড়াও বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে ৬৭ জন কোয়ারান্টাইনে রয়েছেন।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর আন্তঃ সমন্বয়ে বান্দরবান জেলার মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংগঠন বিএসএমএ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। সংকটময় সময়ে তাদের এই উদ্যোগকে প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাই ভবিষ্যতে পাহাড়ের হাল ধরবে। তারা নিজে থেকেই উদ্যোগী হয়ে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কঠিন সময়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানুষকে সতর্ক করতে উদয়অস্ত পরিশ্রম করছেন। বিএসএমএসহ যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বান্দরবানের মানুষদের নিরাপদ রাখতে ভূমিকা রাখছেন তাদের প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা।
উপজেলার মানুষদের মধ্যে সতর্কতা সৃষ্টি করতে তারা প্রতিদিন বান্দরবান উপজেলার প্রতিটি ঘরে সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের এই উদ্যোগে উপজেলা মানুষের পক্ষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা যখন মানুষের কাছে সতর্কবাণী পৌঁছায়, তখন মানুষ তাদের কথায় আস্থা অর্জন করে। চিকিৎসক হতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের কথায় তারা গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বান্দরবান উপজেলাসহ এই পার্বত্য জেলার সব উপজেলায় করোনার আগ্রাসী থাবা রুখে দিতে সক্ষম হবো।
প্রসঙ্গত, বান্দরবান মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএসএ) এর পাশাপাশি এই পার্বত্য শহরে যুব রেড ক্রিসেন্ট বান্দরবান, বান্দরবান স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিডি ক্লিন বান্দরবান, বান্দরবান মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিলসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেক ব্যক্তি করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।
মৈত্রী/ এএ