অর্থপাচার-হুন্ডির লাগাম টানতে চাই সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ

অর্থনীতি ডেস্ক : অর্থ পাচার এবং হুন্ডি কার্যক্রম বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং আর্থিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বর্ধিত বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সাথে সাথে অর্থ পাচার এবং হুন্ডি তৎপরতার ঝুঁকি আরও বাড়ছে। এই দুইটি সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। একইসঙ্গে দেশের আর্থিক খাতের উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে। অর্থ পাচার ও হুন্ডি কার্যক্রম রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, নীতিমালা প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

অর্থ পাচার বলতে বুঝায়, দেশের অভ্যন্তরে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থকে আইন ও নিয়মকানুনের বাইরে দেশের বাইরে স্থানান্তর করা। বাংলাদেশে অর্থ পাচারের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, কর ফাঁকি, দুর্নীতি, ঘুষ এবং অবৈধ ব্যবসা। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নামে মিথ্যা ইনভয়েস বা আন্ডার/ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়। অর্থ পাচারের এই ধরনের কার্যকলাপ অর্থনীতির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

অর্থ পাচারের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অর্থ পাচার মূলত দেশের উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই অর্থ বিদেশে চলে যায়, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে দেয়। এর ফলে, আমদানি-রপ্তানি খাতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া, পাচারকৃত অর্থের কারণে দেশের বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি কমে যায়, যা দেশের উন্নয়নকে ধীরগতির করে দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থ পাচারের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক অর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই বিপুল অর্থের বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু ব্যক্তি উদ্যোগেই নয়, অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকও। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, গেল প্রায় দেড় যুগে দেশীয় ১৯টি ব্যাংকে আত্মসাৎ করা মাত্র ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমেই প্রায় একশ হাজার কোটিরও বেশি টাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে । এই অর্থ পাচারের ফলে দেশীয় অর্থনীতিতে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, এবং বিদেশে অবৈধভাবে সম্পদ গড়ে উঠছে। দেশের জন্য এই অর্থ ফিরে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।

হুন্ডি হলো একটি অবৈধ অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়া, যেখানে অর্থ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে অন্যভাবে পাঠানো হয়। এটি মূলত একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক, যেখানে কোনও কাগজপত্র বা বৈধ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো অর্থের কোনও নথি থাকে না, ফলে এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। বাংলাদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে প্রেরিত অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসে, যা দেশে বৈধভাবে অর্থ প্রেরণের প্রক্রিয়ার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

হুন্ডি কার্যক্রম দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায় এবং দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। এছাড়া, হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত অর্থের কোনও বৈধতা না থাকায় এটি বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং সন্ত্রাসবাদে ব্যবহার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে দেশের আর্থিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট হয়।

হুন্ডি কার্যক্রমের আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো, এটি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়। ব্যাংকের মাধ্যমে বৈধভাবে অর্থ প্রেরণ করতে অনেক সময় এবং খরচ হয়, যেখানে হুন্ডির মাধ্যমে তা সহজে এবং কম সময়ে করা সম্ভব। এর ফলে, দেশের বৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আর্থিক খাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।

অর্থ পাচার এবং হুন্ডি কার্যক্রম রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২। এই আইনের আওতায় অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গঠন করা হয়েছে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে সন্দেহজনক লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

সরকারের উদ্যোগে হুন্ডি তৎপরতা বন্ধে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে বৈধ উপায়ে অর্থ প্রেরণকারীদের সংখ্যা বাড়ছে এবং হুন্ডির ব্যবহার কমছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনও এই প্রক্রিয়ায় আরও কঠোরতা এবং কার্যকর ব্যবস্থা প্রয়োজন।

বিএফআইইউ এর তত্ত্বাবধানে, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের লেনদেনগুলোর ওপর আরও বেশি নজরদারি করতে বলা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংককে একটি পৃথক ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গঠন করতে বলা হয়েছে, যা সন্দেহজনক লেনদেনের ওপর নজর রাখবে এবং তা বিএফআইইউ-তে রিপোর্ট করবে। এছাড়া, অনলাইনে ব্যাংকিং কার্যক্রমের উপরও বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, কারণ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঝুঁকি অনেক বেশি।

অর্থ পাচার এবং হুন্ডি কার্যক্রম শুধুমাত্র একটি দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এজন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থ পাচার রোধে কাজ করছে। এর মধ্যে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এফএটিএফ-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, অর্থ পাচার প্রতিরোধে দেশের নীতি ও কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।

এছাড়া, বাংলাদেশ সরকার আরও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং আন্তর্জাতিক পাচার চক্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিক মানের অর্থ পাচার বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন এবং কার্যকর প্রয়োগে সহায়তা করছে। তবে, এই উদ্যোগগুলোকে আরও কার্যকর করতে বাংলাদেশের উচিত দেশের অভ্যন্তরীণ আইন এবং নীতি প্রয়োগকে আরও শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতা বজায় রাখা।

অর্থ পাচার এবং হুন্ডি কার্যক্রম রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সাধারণ মানুষকে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত করতে হবে, যাতে তারা সচেতনভাবে হুন্ডি বা অবৈধ উপায়ে অর্থ প্রেরণের ঝুঁকি এড়িয়ে চলে। বিশেষ করে, প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে হুন্ডির ব্যবহারের প্রবণতা কমাতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম এবং প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক শিক্ষা ও সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করবে। দেশের অর্থনীতির উপর অর্থ পাচার এবং হুন্ডি কার্যক্রমের যে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে হবে।

প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। যেমন, বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে, যেখানে তাদের বৈধভাবে অর্থ প্রেরণের সুবিধা এবং হুন্ডির ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে। এছাড়া, প্রবাসী শ্রমিকদের বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করার জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করা।

 

লেখক: মাহমুদুল হাসান এফসিসিএ, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, পিকেএসএফ

মৈত্রী/ এএ

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *