পার্বত্যশীর্ষ খবর

দোষী কর্মকর্তা পদায়ন: পাহাড়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতি সরাসরি আঘাত

সম্প্রতি মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে অষ্টম শ্রেণির কিশোরী ছাত্রীদের ফেসবুক আইডি ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে কুপ্রস্তাব পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। বিস্ময়করভাবে এই কর্মকর্তা সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলার সদর উপজেলায় সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে পদায়িত হয়েছেন। এই পদায়ন পাহাড়ের নিরাপত্তা মর্যাদার প্রতি সরাসরি আঘাত বলে মন্তব্য করে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন বান্দরবান জেলা পরিষদের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আবু জাফর

বিবৃতিটি নিচে প্রকাশ করা হলো

১৭ জুলাই প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ছাত্রীরা কুপ্রস্তাব দেয়ার বিষয়টি প্রথমে অভিভাবকদের জানায় এবং পরে ১৩ জুলাই ও ১৫ জুলাই দুটি পৃথক লিখিত অভিযোগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দাখিল করা হয়। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানীয় প্রশাসন তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কর্মকর্তা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস. এম. আব্দুল্লাহ বিন শফিক তার কার্যালয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাসহ উভয়পক্ষকে নিয়ে শুনানিও করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো চূড়ান্ত হয়নি তবে মনিরুজ্জামান খান ইতোমধ্যেই দোষ স্বীকার করেছেন।

সংবাদপত্রে উদ্ধৃত তার বক্তব্য ছিল, ‘তদন্তে আমি আমার দোষ স্বীকার করেছি, না করার উপায় নেই। স্কুল না হয়ে অন্যক্ষেত্রে হলে হয়তো সেক্রিফাইস করতো। ইউএনওসহ এরা কেউ সেক্রিফাইস করবে না। আমি অন্যায় করেছি, ডিপার্টমেন্ট আমাকে শাস্তি দেবে।’

কেন এই পদায়ন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত?

বান্দরবান একটি পার্বত্য ও বহুবিচিত্র জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। এখানকার শিশুরা, বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন নানান সামাজিক ও ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিদ্যালয়ে আসে। পাহাড়ি মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে এখনও অনেক পরিবারকে দোলাচলে পড়তে হয়। এই বাস্তবতায় একজন অনৈতিক, দোষ স্বীকারকারী পুরুষ কর্মকর্তাকে দায়িত্বে বসানো শুধু দায়িত্বহীনতা নয়, এটি সরাসরি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, বিদ্যালয়ের মর্যাদা এবং স্থানীয় সমাজের বিশ্বাসের ওপর আঘাত। অভিযুক্ত ব্যক্তি যেহেতু সরকারি পদে থেকে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন এবং কিশোরী ছাত্রীর ওপর মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ স্বীকার করেছেন, তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে পদচ্যুতিমূলক বা সাময়িক অব্যাহতির ব্যবস্থা নেওয়াই ছিল স্বাভাবিক প্রশাসনিক রীতি। কিন্তু তার বদলে এমন এক জেলায় পাঠানো হলো, যেখানকার প্রশাসনিক কাঠামো তুলনামূলক দুর্বল এবং জবাবদিহিতার সুযোগ সীমিত। এমন নিয়োগের ফলে পাহাড়ের স্কুলগুলোতে মেয়েরা কীভাবে নিরাপদ বোধ করবে?

প্রশাসনের নীরবতা ও দায়:

এই পদায়নের ঘটনায় বান্দরবানের প্রশাসন এখনো নীরব। শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক পাঠানো অফিস আদেশ হুবহু বাস্তবায়ন করে কি স্থানীয় প্রশাসনের দায় শেষ হয়ে গেল? এ জেলায় দায়িত্বরত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি আদৌ জানেন না ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ রয়েছে? তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে দেশের একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে আসা এমন ঘটনার পরও যদি প্রশাসনের কেউ ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তা দায়িত্বহীনতা নয় বরং নৈতিক পিছুটান। শুধু তা-ই নয়, এমন নিরবতায় আসন্ন মেয়েরা, তাদের অভিভাবকরা এবং শিক্ষক সমাজ হতাশ ও ক্ষুব্ধ।

পাহাড়ে একজন যৌন হয়রানিকারীর জায়গা নেই

এটি শুধু এক ব্যক্তির বদলির গল্প নয়। এটি একটি সমাজের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং সম্মানের প্রশ্ন। বান্দরবানে এমনিতেই নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, পাচার এবং নির্যাতনের মতো ঝুঁকি বিদ্যমান। এখন যদি একজন স্বঘোষিত দোষী শিক্ষা কর্মকর্তার হাতেই প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়, তাহলে তা পাহাড়ের প্রতি অবিচার। একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নৈতিক বিচ্যুতি কখনোই তার পেশাগত নিরাপত্তা দিতে পারে না। একজন ‘অনৈতিক’ ব্যক্তি কখনোই ‘নিরাপদ’ বা ‘বিশ্বস্ত’ হতে পারেন না। পদায়ন অবিলম্বে বাতিল না হলে এই মুহূর্তে বান্দরবানের প্রশাসনের উচিত, শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে চিঠি পাঠিয়ে এই পদায়নের ব্যাখ্যা চাওয়া এবং দ্রুত পদায়ন বাতিলের দাবি তোলা। প্রয়োজনে গণস্বাক্ষর, শিক্ষক সংগঠন ও অভিভাবক ফোরামের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দিয়ে বিষয়টি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তোলা প্রয়োজন।

এই কলঙ্কের বোঝা বান্দরবান বইবে না। এ জেলায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রশাসনের নীরবতা বা অক্ষমতা সেই দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে না।

মৈত্রী/ এএ

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *