নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য জোর করা যাবে না এ সাংবিধানিক অধিকার : শাহদীন মালিক
স্টাফ রিপোর্টার,
লিগ্যাল ভয়েস ডেস্ক : শাহদীন মালিক বলেন কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য জোর করা যাবে না, যা একটি সাংবিধানিক অধিকার। তবে রিমান্ডের ফলে এটি ব্যাপক হারে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
আজ বুধবার সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘নির্যাতন রোধের দায়-দায়িত্ব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। ২৬ জুন আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস উপলক্ষে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে শাহদীন মালিক বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটরা রিমান্ডে দিয়ে প্রতিদিনই সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। আমরা সবাই জানি, রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তো হাজির বিরিয়ানি খাওয়ায় না। যাকে ধরা হচ্ছে সে কী অপরাধ করেছে, কোথায় টাকা রেখেছে, এগুলো বলতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না—এটা বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭২ সালের সংবিধানেই আছে। রিমান্ডে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটেরা প্রতিনিয়ত সংবিধান লঙ্ঘন করছেন।’
শাহদীন মালিক বলেন, ‘এখন আমরা সবচেয়ে বেশি অধিকারহীনতায় ভুগছি। বাহ্যিক কিছু উন্নয়ন হচ্ছে বিয়ের সময় লাইট লাগানোর মতো। প্রতি সপ্তাহে একনেকের সভা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট পাস হচ্ছে। এসব বিয়ের আলো জ্বালানোর উন্নতি হচ্ছে, অধিকারগুলো সংরক্ষণ হচ্ছে না। আমরা সবাই চাই, উন্নত দেশের কাতারে এই দেশটা যাবে। তবে অধিকার না দিয়ে কোনো সমাজ উন্নতি করতে পারে না। অধিকার না দিলে ২০৪১ কেন, ২০৬১ সালের মধ্যেও কোনো ধরনের উন্নতি সম্ভব নয়।’
শাহদীন মালিক বলেন, কথা বললেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে বা উন্নত হবে, তা নয়। তবে কাজ হবে না বলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে কথা না বললে পরিস্থিতির উন্নতিও হবে না। নির্যাতন প্রতিরোধ করতেই হবে। নয়তো একদিন না একদিন সবাই এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি উপস্থাপনা শেষে বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্যাতকের শক্তি দেশের আইন, বিচারব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির চেয়ে অনেক বেশি। এটা একটা নির্যাতনবান্ধব দেশ। এই চিত্র যদি আমরা প্রতিদিন দিতে থাকি, তাহলে আমার মনে হয় না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ১৯৭২–এর সংবিধান এবং আমরা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের যেসব ভিত্তি নিয়ে কথা বলি, সেটার প্রতি আমরা আদৌ শ্রদ্ধাবান আছি।’
আসিফ নজরুল তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের সদস্য হয়। কিন্তু এই কনভেনশনের চুক্তিটির প্রতি বাংলাদেশের আন্তরিকতার অভাব ফুটে ওঠে। বাংলাদেশের দায়িত্ব ছিল, চুক্তির পক্ষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে এবং প্রতি চার বছর অন্তর নির্যাতনবিরোধী কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া। কিন্তু ২১ বছর পার হওয়ার পরও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত একটি প্রতিবেদনও জমা দেয়নি।
পুলিশের ওপর এক ধরনের চাপ থাকে মন্তব্য করে আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘তাজউদ্দীন আহমেদের নাতি গুমের ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ তাঁর ভাতিজাকে ফেরত পাওয়ার পর পুলিশকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রশ্নটা তুলে নাই যে কারা তাঁকে তুলে নিয়েছিল, কেন তাঁকে নেওয়া হয়েছিল। ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে, রাষ্ট্রে এই ধরনের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক এবং আমাদের এই ধারণার ফলে রাষ্ট্র সুপ্ত একটি অনুমোদন পাচ্ছে এই সমস্ত অন্যায় করার।’
এটা একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র মন্তব্য করে হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘এটা প্রধানমন্ত্রী, এক ব্যক্তির রাষ্ট্র। এটা ব্রিটিশের রানির রাষ্ট্র ছিল, এটা গভর্নর জেনারেলের রাষ্ট্র ছিল, এটা সামরিক শাসকদের রাষ্ট্র ছিল অথবা এটা এখন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোটাই এখন এ রকম যে রাষ্ট্র একজনের হাতের মুঠোয়। যিনি এটাকে হাতের মুঠোয় নিতে পারেন, তিনি যে–ই হোন, একই রকমের ভূমিকা পালন করবেন।’
আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘নির্যাতন বন্ধের পাশাপাশি আমাদের সাংবিধানিক অধিকারসহ নিষ্ঠুর, অমানবিক সাজার শিকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে সবাই মিলে আওয়াজ তোলার এখনই সময়।’ মানবাধিকার কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও আইনজীবীদের ভূমিকা আরও জোরদার কেন হচ্ছে না সে ব্যাপারে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সদস্য শিরিন হকের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির ছাত্র লিমন হোসেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা আতাউল্লাহ প্রমুখ।