কামরুন্নাহার ডানা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ‘ডানা’
জিল্লুর রহমান,
কামরুন্নাহার ডানা জন্ম রংপুরে। দেশের ক্রীড়াঙ্গন বিশেষ করে মহিলা ক্রীড়াঙ্গনের একটি পরিচিত নাম। যিনি খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নিলেও এ অঙ্গনের সঙ্গে আজও রয়ে গেছেন সংগঠক হিসেবে। ডানা নামের সঙ্গে ভেসে ওঠে ব্যাডমিন্টনের কোর্টে প্রজাপতির মত দাপিয়ে বেড়ানো একটি মুখ। ব্যাডমিন্টনে বেশি পরিচিতি পেলেও সমানতালে খেলেছেন টেবিল টেনিসও।
দেশের প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে দুই ডিসিপ্লিনে জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৭৯ সালে ব্যাডিমিন্টনে। পরের বছর টেবিল টেনিসে। কোর্ট ছাড়লেও খেলার জগতকে ছাড়তে পারেননি। সংগঠক হিসেবে নেপথ্যে ভবিষ্যৎ খেলোযাড় তৈরির কাছে নিজেকে নিয়োজিত করেছন। শুধু খেলার মাঠেই নয় তার বিচরণ বিভিন্ন অঙ্গনে।
১৯৮৫ সালে খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় ঢাকা মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের মহিলা সম্পাদিকার দায়িত্ব পেয়ে ব্যাপক পরিসরে সংগঠক হিসেবে যাত্রা শুরু। ২০০৯ সালে নির্বাচিত পরিচালক হিসেবে সূচনা আজও এ পদেই আছেন। ১৯৮৬ সালে ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে টানা ১১ বছর, এক বছর ছিলেন সহ-সভাপতি। ১৯৯১ সাল থেকে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দুই মেয়াদে ১০ বছর ছিলেন সাধারণ সম্পাদিকা। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্পেশাল অলিম্পিকের পরিচালক।
বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলাররা আজ বয়সভিত্তিক আসর সাফল্য পাচ্ছেন। ২০০৩ সালে তার হাত ধরেই এদেশে যাত্রা শুরু মহিলা ফুটবলের। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাফুফের উইমেন উইংয়ের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে এগিয়ে নেন মহিলা ফুটবলকে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) উইমেন উইংয়েরও সহ-সভাপতি ছিলেন। ২০১০ সাল থেকে সাত বছর ছিলেন হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি।
দুই মেয়াদে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য ছিলেন। ২০১০ সালে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ কনটিনজেন্টের ম্যানেজার ছিলেন। ক্রীড়া সংগঠকের পাশপাশি দেশের ক্রীড়ালেখক ও সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস এসোসিয়েশনের সদস্য ১৯৭৭ সাল থেকে। বেশ কয়েক মেয়াদে নির্বাহী সদস্য, যুগ্ম সম্পাদিকা ও সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৫ সালে কুইবেকে এবং ২০০২ সালে টরন্টোয় ক্রীড়া সাংবাদিকদেও সর্বোচ্চ সংগঠন এআইপিএস এর কংগ্রেসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সংগঠক হিসেবে হাতেখড়ি ১৩ বছর বয়সে নিজ শহর রংপুরে এলাকার সবাইকে নিয়ে ক্রীড়া, সাহিত্য ও সাংস্কৃদিক সংগঠন ‘লাবনী সংঘ’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের দুই মেয়াদে ইনডোর গেমস সেক্রেটারী এক মেয়াদে সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত ছিলেন। একই সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের হল শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ছিলেন।
বিভিন্ন আসরে খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে সেমিনারে অংশ নিতে ভ্রমণ করেছেন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, কম্বোডয়া, ব্রুনেই, হংকং, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, আয়ারর্যান্ড, গ্রীস, অস্ট্রলিয়া, কুয়েত, কাতার, মার্কিন যুক্তরান্ট্র, কানাডা, ইংল্যঅন্ড, জার্মানী, ইতালি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও সুইডেন।
ডানার জন্ম ১৯৫৯ সালের ২২ নভেম্বর রংপুরের মুন্সীপাড়ায়। পিতা মো: আজফার, মাতা আয়েশা আজফার। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে সকলের ছোট তিনি। একমাত্র চাচা মো: আকতার পাকিস্তান আমলে রংপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বড় ভাই মো: আফজাল গণতন্ত্র পার্টিও সাবেক সভাপতি-দুই মেয়াদে (১৯৭৯-১৯৮৮) রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।
ক্রীড়া, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় শিশুকালেই। ১৯৭৬ সাল থেকে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিসে অংশগ্রহণ, ১৯৭৯ সালে এককে রানার আপ, দ্বৈত ও মিশ্র দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮১ সালে বরিশালে জাতীয় আসরে প্রথমবার এককে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে তিন ইভেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে ট্রিপল ক্রাউন অর্জন। মাঝে ১৯৮৩ সালে তিন ইভেন্টের ফাইনালে ঊঠেও বর্জন। যা ছিল সে সময়ের প্রেক্ষিতে অতি সাহসী এক সিদ্ধান্ত। ১৪ ফেব্রুয়ারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিলে তৎকালীন ছাত্রলীগের দুই নেতা সেলিম ও দেলোয়ায়র নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ফাইনাল বয়কট, নইলে টাানা তিন আসরে ট্রিপল ক্রাউনের অনন্য রেকর্ডেও অধিকারী হতেন। এ নিয়ে কোন ক্ষোভ নেই- এতদিন পরে এসেও সেদিনের ঘটনা নিয়ে এক কথায় ডানার উত্তর- ‘আমি গর্ব বোধ করি।’
এছাড়াও জীবনে বিভিন্ন সময়ে পরিচয় দিয়েছেন সংগ্রামী চেতনার। ১৯৮২ সালে তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে এক ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্তমান বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনসহ চার ফুটবলার (চুন্নু, হেলাল ও আনোায়ার) সামরিক আইনে জেলে যান। তদের মুক্তির আবেদন নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এরশাদে কাছে চিঠি প্রদানের জন্য অন্য খেলোয়াড়রা যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না গ্রেফতারের ভয়ে। তখন তিনি সে চিঠি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান জেনারেল ওয়াহেদের কাছে পৌঁছে দেন। একইভাবে ২০০৩ সালে অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে ঢাকায় মহিলা ফুটবলের আয়োজনে অগ্রণী ভুমিকা নেন। যার ফলশ্রুতিতে আজ বয়সভিত্তিক আসরে সাফল্য পাচ্ছে বাংলাদেশ।
১৯৭৭ সালে তৎকালীন দৈনিক বাংলায় রংপুরের লাবনী সংঘের উপর লেখা ফিচার দিয়ে তার লেখালেখির সূচনা। তার পর ক্রীড়া বিষয়ে লিখেছেন ক্রীড়াজগত, দৈনিক বাংলা, সংবাদ, বাংলার বাণী, দেশজনতাসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯৭২ সালে রংপুর বেতারে শিশুশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় ‘বি’ গ্রেডে নাট্যশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত। পরের বছর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্রীড়া সংবাদ পাঠিকা ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানে উপস্থাপিকা হিসেবে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন।
১৯৮৫ সালে ব্যাডমিনটনে মিক্স ডাবলসের পার্টরার প্রকৌশলী শেখ আবুল হাসেমকে লাইফ পার্টনার হিসেবে জীবন চলার পথের সঙ্গী করেন। এ জুটির দু-সন্তান। বড় ফারাহ তাসসিন সৃষ্টি একটি বহুজাতিক কোম্পনীর এইচআর ডিপার্টমেন্টে চাকুরীরত। ছেলে শেখ রিফাত দাইয়ান সৃজন ক্যালিফোর্নিয়ার স্টানফোর্ড
ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশুনা করছে।
জীবনে চলার পথে সব সময়ই ছিলেন আপোষহীন, ফলে এসেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটিতে বাদ পড়তে হয়েছে অন্যায়ভাবে। তবুও থেমে নেই তার পথচলা। সব কিছু পিছনে ফেলে ফিরে পেয়েছেন নিজের জায়গা।
খেলোয়াড়ী জীবনে ও সংগঠক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে নানা সম্মাননা ও পদকে ভুষিত হয়েছেন। ১৯৯৯ সালে খেলোয়াড় ও সংহগঠক হিসেবে লাভ করেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। তার স্বামী আবুল হাশেমও ২০০৮ ব্যাডমিন্টনে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম দম্পতি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন এ জুটি।