ভেনেজুয়েলা ইস্যু কেন এত আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক,
লিগ্যাল ভয়েস : যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ভেনেজুয়েলা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটিকে ঘিরে দুই পরাশক্তির নানা পদক্ষেপে সেখানকার সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।
বিরোধীদলীয় নেতা হুয়ান গুইদোর ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে যে, তারা ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে।
আমেরিকান থিংক ট্যাংক র্যান্ড কর্পোরেশনের বিশ্লেষক জেমস ডোবিন্স বলেন, ‘একটা সময়ে মনে করা হতো, ভেনেজুয়েলার সংকট আসলে দুই নেতা মাদুরো আর গুইদোর মধ্যকার একটি বিরোধ। কিন্তু এখন সেটা বরং রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ বলেই মনে হচ্ছে।’
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এটি যেন দক্ষিণ আমেরিকায় সেই পুরনো স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে ফিরে যাওয়ার মতো ব্যাপার, যখন দুই পরাশক্তির বিরোধের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিউবা।
কিন্তু কেন ভেনেজুয়েলা নিয়ে এই টানাটানি? এর আসলে কোন সহজ উত্তর নেই। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক স্বার্থের ব্যাপারটি এখানে মিলেমিশে দেশটির বর্তমান সংকট তৈরি করেছে।
হুগো শ্যাভেজের শাসনামলে (১৯৯৯-২০১৩) ওয়াশিংটন এবং কারাকাসের মধ্যে মাঝেমাঝে উত্তেজনা হয়েছে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। ডোবিন্স ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বহু বছর ধরে ভেনেজুয়েলার তেলের প্রধান ক্রেতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক তেল পরিশোধনাগার শুধুমাত্র আমেরিকায় তেল পাঠানোর জন্যই কাজ করত।’
কিন্তু ২০১৩ সালে মাদুরো ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। দেশটির অনেক ব্যক্তি এবং কোম্পানির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করা হলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ভেনেজুয়েলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন রাশিয়া আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। রাশিয়ার অনেক আন্তর্জাতিক নীতিতে সমর্থন দিতে শুরু করেছে ভেনেজুয়েলা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার পর রাশিয়া যে কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছিল, সেটি কাটাতে মস্কো অন্যত্র বন্ধু খোঁজার চেষ্টা শুরু করেছে।
মার্কিন থিংক ট্যাঙ্ক ব্রকিংস ইন্সটিটিউটে গবেষণারত ইউক্রেনে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিভ পিফের বলেন, ‘মস্কো এখন এমন দেশ খুঁজছে, যারা আগ্রহের সঙ্গে সম্পর্ক করবে, আর এরকম একটি দেশ হলো ভেনেজুয়েলা।’ যুক্তরাষ্ট্র যত সরে যেতে শুরু করেছে, রাশিয়া ততই ভেনেজুয়েলার সঙ্গে জড়িত হতে শুরু করে। গত এক দশক ধরে রাশিয়ার তেল কোম্পানি রোসনেফ্ট দেশটির তেল খাতে তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েই চলেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন, ২০০৬ সাল থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার ঋণের বদলে তেল নিয়েছে রোসনেফ্ট ও রাশিয়ার সরকার। ডোবিন্স বলেন, রাশিয়ার ঋণ পুরোপুরি পরিশোধের ক্ষমতা নেই ভেনেজুয়েলা সরকারের। আর দেশটিতে ক্ষমতার পরিবর্তন মানে হলো তাদের অর্থকড়ি ফেরতের সম্ভাবনা আটকে যাওয়া।
মাদুরো বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে আসছেন যে, তারা দেশটির তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। ডবিন্স বলেন, ‘সন্দেহ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভেনেজুয়েলা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং সেই সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করতে চাইবে। কিন্তু আমি এই অভিযোগ মানতে রাজি নই যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়।’
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেও মস্কো থেকে পাওয়া সমর্থনের প্রশংসা করছে ভেনেজুয়েলা প্রশাসন। কলম্বিয়ার রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষক ভ্লাদিমির রোভিন্সিকি বলেন, রাশিয়ার কাছে আসলে তেল নয়, ভেনেজুয়েলায় অন্য স্বার্থ রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ব্যবসার দিক থেকে রাশিয়ার অনেক বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। ভেনেজুয়েলার তেলের খনি থেকে লাভ করতে হলে সেখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘রাশিয়ানরা আসলে মাদুরো সরকারকে সহায়তা করার জন্য এই আবরণ দিয়েছে। কারণ রোসনেফ্টের যেখানে নিজস্ব তেল খনি রয়েছে, সেখানে ভেনেজুয়েলার তেলের পেছনে এতো বেশি অর্থ বিনিয়োগ করার কোন মানে নেই।’
ডবিন্সও বলেন, আমেরিকান তেল আর গ্যাস শিল্প আমদানির ওপর কমই নির্ভরশীল।
বিবিসির রাশিয়ার সার্ভিসের সম্পাদক ফামিল ইসমাইলভ ব্যাখ্যা করছেন, এর একটা মূল বিষয় হলো পুতিন রাশিয়ার জনগণকে একটি বার্তা দিতে চান। রাশিয়ার জনগণকে এটা দেখানো জরুরি যে, অবরোধ সত্ত্বেও রাশিয়া একটি পরাশক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখছে এবং তার বন্ধু দেশ রয়েছে।
তবে ভেনেজুয়েলার ব্যাপারটি ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডবিন্সের মতে, ‘দক্ষিণ ফ্লোরিডায় ভেনেজুয়েলা থেকে আসা বিশাল একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে। এছাড়া কিউবা থেকে চলে আসা লোকজনও রয়েছে, যারা ভেনেজুয়েলা সরকারের পরিবর্তন দেখতে চায়।’
কিউবা আর ভেনেজুয়েলার মধ্যে সামরিক সহযোগিতাসহ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। ডবিন্স বলেন, ‘২০২০সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে আর ফ্লোরিডাকে যদি আমরা ভোটের বিচারে দোদুল্যমান স্টেট হিসাবে ধরে নেই, তাহলে এটা বলা যেতে পারে যে, ভেনেজুয়েলা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্যাম্পেইনের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে।’
পাশাপাশি ভেনেজুয়েলার মানবাধিকার পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে, কারণ অনেক অভিবাসী এসব দেশে আশ্রয় নিতে চাইছেন।
ভ্লাদিমির রোভিন্সিকি বিশ্বাস করেন, মস্কো তাদের নিজস্ব খেলায় ওয়াশিংটনকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। রাশিয়ানদের মতে, ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং অন্য সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মস্কোর যে সমস্যা রয়েছে, তা আমেরিকান মদদে হয়েছে। রোভিন্সিকি বলেন, রাশিয়াও চাইছে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোয় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে, যা হতে পারে আমেরিকার পেছন দরজায় কড়া নাড়ার মতো।