যুদ্ধাপরাধী ও বিচার কার্যক্রম
বীরমুক্তিযোদ্ধা রিন্টু চৌধুরী,
লিগ্যাল ভয়েস : মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অন্তত ১৩১ জন পালিয়ে গেছে। পলাতকদের মধ্যে যেমন আছেন অভিযুক্ত, তেমনি আছে বিচারে দণ্ডপ্রাপ্তও। অনেকে দেশেই আত্মগোপন করে আছেন, কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। দীর্ঘ সময় ধরে একে একে আত্মগোপনে চলে গেলেও তাদের গ্রেপ্তারে বা পালিয়ে যাওয়া রোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
পুলিশ প্রশাসনকে বারবার নির্দেশনা দেয়া সত্তেও ব্যর্থ হচ্ছে তারা। আসামি গ্রেপ্তারে সফলতা না থাকায় স্বয়ং ট্রাইব্যুনালও একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন এ বিষয়ে। জানা যায়, বিচারিক কার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে ৩৯ জন দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে ২৭ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, আর ১২ জন আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। এছাড়া তদন্ত পর্যায়ে পালিয়ে যায় আরও ৯২ জন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম। কেউ কেউ আগে থেকেই বিদেশে পালিয়েছিল। আবার কেউ কেউ তদন্ত শুরু হওয়ার পর বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পালিয়ে যায়।
২০১৫ সালের ১৩ মে ট্রাইব্যুনাল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেয়। আদেশটি হলো- ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পলাতক সব আসামিকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে ১৫ দিনের মধ্যে একটি মনিটরিং সেল গঠন, সেই সঙ্গে ৪০ দিন পর পর এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও কোনো ফল লক্ষ করা যায়নি। ইতোমধ্যে পুলিশ ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকবার প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু তারা বরাবরই তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে আসছে ট্রাইব্যুনালের কাছে
ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টদের মতে, যুদ্ধাপরাধী পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতে ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিলেও এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইনজ্ঞ নিয়োগ করা, যেটি ওই দেশগুলোর সঙ্গে আইনি জটিলতা নিষ্পত্তি করতে কাজ করবে।
পলাতকদের ফিরিয়ে দিতে ওই দেশগুলোর সরকারকে রাজি করতে লবিস্ট নিয়োগ করা যেতে পারে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেই তাদের নজরদারিতে রাখার কথা। যথাযথ নজরদারি না থাকায় তারা পালিয়ে যেতে পেরেছে। ট্রাইব্যুনালের এক রায়ে বলা হয়েছে, স্থানীয় রাজাকাররাই সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর ছিল। এরা নিজ হাতে সাধারণ মানুষ, স্বাধীনতাকামী মানুষকে খুন করেছে। রাজাকার, আলবদর, আল-শামসসহ নানা নামে তারা চালিয়েছে লুটপাট, নারী ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করা, অপহরণ, নির্যাতনের মতো ভয়াবহ কর্মকাণ্ড।
যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের এপ্রিলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এর আগেই পালিয়ে যায় এ যুদ্ধাপরাধী। এ ঘটনায় তোলপাড় ওঠে সারাদেশে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নড়েচড়ে বসে। ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল বাচ্চু রাজাকারের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ মামলায় ফাঁসির আদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু গত সাত বছরেও ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এই যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করা যায়নি। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলেও রেড অ্যালার্ট জারি রয়েছে। তবে বাচ্চু রাজাকার ঠিক কোন দেশে আত্মগোপন করে আছে, তা নিশ্চিত নয় কেউ। শুধু বাচ্চু রাজাকার নয়, তারমতো দণ্ডপ্রাপ্ত আরও ৩৮ জন যুদ্ধাপরাধী পালিয়ে আছে। দণ্ডপ্রাপ্ত এসব যুদ্ধাপরাধীরা যতদিন পালিয়ে থাকার সুযোগ পাবে, ততদিনই তারা দেশের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা চালাবে। যে কোনো মূল্যে এদের গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির দণ্ডিত এসব যুদ্ধাপরাধী গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদন্ত সংস্থার গাফিলতি রয়েছে, শৈথিল্য রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল (এনসিবি) শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, এসব যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে বাচ্চু রাজাকার ছাড়া আরও ৬ জন বিদেশে আত্মগোপনে আছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি রয়েছে রেড নোটিশ। তবে এখনো ইন্টারপোল থেকে তাদের বিষয়ে তথ্য মেলেনি। বাচ্চু রাজাকার ছাড়া ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি থাকা অন্য ৬ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে রয়েছে- আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মইনুদ্দিন, জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার, সৈয়দ হাসান আলী ও সৈয়দ মুহম্মদ হোসাইন। এছাড়া বাকিরা কোথায় আছে তাও জানে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।