সড়কে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়!
স্টাফ রিপোর্টার,
লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :
রাজধানী সহ সারা দেশে সড়কে নৈরাজ্য অবসানের কোনো লক্ষণ নেই। শৃঙ্খলা ফেরাতে বারবার কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বিভিন্ন কমিটির দফায় দফায় করা শত শত সুপারিশ পরিণত হচ্ছে ফাঁকা বুলিতে। পুলিশ, বিআরটিএ, সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা স্পষ্টই নজরে পড়ে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা একাধিকবার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে সড়কে নৈরাজ্য ঠেকানোর কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
সড়ক নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দেয়া নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পরিস্থিতি সেই আগের মতোই।
রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় মঙ্গলবার ফুটপাতে গতিতে ধাবমান বাসের চাপায় পা হারিয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক (অর্থ) কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। এরপর সড়ক নৈরাজ্যের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।
গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার সড়কে গতিদানবের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন দুলু মিয়া নামের এক ভ্যানচালক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ও প্রশাসন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় সড়কের নৈরাজ্য থামানো যাচ্ছে না।
সড়ক নিরাপত্তায় গঠিত বিভিন্ন কমিটির দাবি, তদন্ত ও সুপারিশ প্রতিবেদনেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
রাজধানীসহ দেশের সড়ক নিরাপত্তায় সবচেয়ে শক্তিশালী ফোরাম হচ্ছে ‘সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল’। ২০১১ সালে এই কাউন্সিল সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছিল। তা বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তী সময় ২০১২ সালে এই কাউন্সিল ৫২টি স্বল্পমেয়াদি, ১৪টি মধ্যমেয়াদি ও ২০টি দীর্ঘমেয়াদিসহ মোট ৮৬টি সুপারিশ করে। কিন্তু তাও আলোর মুখ দেখেনি।
সাড়ে ৬ বছর পর সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত এই সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল গত সপ্তাহে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১১১টি সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এখন ১১১টি সুপারিশ কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
কিছুক্ষণ আগে ঠিক এভাবেই রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে প্রাণ হারান এক ভ্যানচালক। তারপরও একই জায়গা দিয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার থামেনি। গতকাল রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার ছবি -শাহাদাত হোসেন
গত বছর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বেপরোয়া গতিতে বাস চালানোর ঘটনায় রমিজউদ্দিন স্কুলের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর রাজধানীসহ দেশজুড়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের গণআন্দোলনের মুখে সড়কে নিরাপত্তায় নানা উদ্যোগ নেয় সরকার।
বাসের সামনে চালকদের পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি ঝুলিয়ে রাখা, নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ড ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসের গেট বন্ধ রাখা, যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা না করানোসহ বেশ কিছু দাবি বাস্তবায়নে বিআরটিএ, পুলিশ প্রশাসন ও পরিবহন নেতারা আশ্বাস দেন। ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস হয়। বিআরটিএ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু করে। সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সরব হয়ে ওঠে। আন্দোলনের ফলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কিন্তু কিছুদিন পর আবারো সড়কে নৈরাজ্য শুরু হয়। চালকরা আবারো বেপরোয়া গতির রাজা হয়ে ওঠে। সেই গতি এখনো থামেনি। রাজধানীজুড়ে এখনো চলছে অনিয়ম ও নৈরাজ্য। এখনো এলোপাতাড়িভাবে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে, বাসের গেট বন্ধ রাখা হচ্ছে না, সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের বাসের ভেতরে চালকের ছবি ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি ঝুলিয়ে রাখা হয়নি। এখনো সড়কে বেপরোয়া গতি চালকদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের। রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সামনেই এসব ঘটেছে। কিন্তু পুলিশ, বিআরটিএসহ সবার উদাসীনতায় চালকরা সব সময়ই দায়মুক্ত। বিআরটিএর মোবাইল কোর্টের তৎপরতা এখন একেবারেই নেই।
লেখক ও গবেষক এবং জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এই কাউন্সিল বিভিন্ন সময়ে যেসব সুপারিশ করেছে, সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করলে আজ আর সড়কে কোনো নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা দেখতে হতো না। কিন্তু যাদের ওপর এই দায়িত্ব ছিল তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই বুদ্ধিজীবী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, পরিবহন সেক্টরের কাছে সরকার ও প্রশাসন জিম্মি হয়ে পড়ায় সড়কের নৈরাজ্য থামছে না।
পরিবহন সেক্টরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে সব সরকারের আমলেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই সব নেতার পূর্ণসমর্থনের কারণে পরিবহন শ্রমিকরা কোনো আইনের তোয়াক্কা করে না। তাদের বেপরোয়া গতিদানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে মরছে মানুষ।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নিরাপদ সড়কের জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছি। বিভিন্ন মহলে অনেক দাবি তুলে ধরেছি।
সড়ক নিরাপত্তার জন্য অনেক দাবি আছে, বিভিন্ন কমিটির সুপারিশ আছে। এসব বাস্তবায়নে সরকারের এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি বদলাবে। সড়ক নিরাপত্তায় আর অবহেলা করা ঠিক হবে না। সবাইকে মিলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে।
সড়কে নৈরাজ্য কেন থামছে না জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ওসমান আলি বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন করা মালিক-শ্রমিকদের দায়িত্ব নয়। এটা বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার যখনই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে, আমরা সহযোগিতা করব। তবে শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।