ভ্যানচালক ছেলেটি আজ সরকারি চিকিৎসক
লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর : উদম্য ও চেষ্টায় মানুষ কী না করতে পারে! তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দিলেন মানিকগঞ্জ জেলার তরুণ চিকিৎসক ডা. আল মামুন।
ক্ষুধা ও দারিদ্রতা যেখানে স্কুলের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিতেই বাঁধাগ্রস্থ করছিল সেখানে একক চেষ্টায় আজ তিনি প্রথম শ্রেণীর সরকারি গেজেটেড চিকিৎসক।
শুধু লেখাপড়াই করেননি তিনি, বাবাকে সহযোগিতা করে চালিয়ে নিয়েছেন অভাবের সংসারকেও। কখনও ভ্যান চালিয়ে, কখনও হাটে সবজি বিক্রি করে, কখনও অন্যের বাড়িতে গৃহপরিচারকের কাজ করে সংসারের হাল ধরেছেন। এর সঙ্গেই চালিয়ে নিয়েছেন পড়ালেখা।
মানিকগঞ্জ সদর থানাধীন পুটাইল ইউনিয়নের হাসলী নামক গ্রামের রিকসাচালক খোরশেদ আলমের সন্তান আল মামুন। রিকশা চালিয়ে অসুস্থ স্ত্রীসহ ৪ ছেলেমেয়ের ভরণ-পোষনে হিমশিম খেতেন তিনি।
বাবাকে সহযোগিতা করতে এলাকায় ভ্যান চালানোসহ আরও অনেক কাজ করেছেন। আজ সেই ভ্যানচালক মামুন এলাকাবাসী গর্ব।
জীবন সংগ্রামে উর্ত্তীণ হয়ে গত ১৯ নভেম্বর সফলতার মুখ দেখলেন এই অধ্যাবসায়ী যুবক।
মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত গেজেট অনুযায়ী- ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৪ হাজার ৪৪৩ জন ভাগ্যবান চিকিৎসকের একজন ডা. আল মামুন।
নিজের এমন সাফল্যে আবেগে আপ্লুত ডা. আল মামুন। বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে নিজের অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে প্রথমেই ডা. আল মামুন জানালেন, যে গ্রামে ভ্যান চালিয়েছেন, সুচিকিৎসার অভাবে মানুষকে কষ্ট পেতে দেখেছেন নিজের সেই এলাকার জন্য কিছু করতে চান।
তিনি জানান, এখনো গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষরা অসুখ হলে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ নিয়েই সেবন করেন। আপাত সুস্থ হয়ে উঠলেও এভাবে অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে যে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন তা ভাবেন না। তাদের সুচিকিৎসা দিতেই আমি বেশি আগ্রহী।
তিনি বলেন, এলাকার ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতাকেই ডাক্তার মনে করেন গ্রামের অধিবাসীরা। বড় ডাক্তারদের ফিস দিতে হবে এমন ভাবনা থেকেই দরিদ্রপীড়িতরা এমন করেন। আজ দেশের মানুষকে আমার অনেক কিছু দেয়ার সময় এসেছে। সে সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সবার কাছে দোয়া চাই যেন একজন ভালো মানবিক ডাক্তার হতে পারি।
চিকিৎসক হওয়ার পেছনে শুধু নিজের সংগ্রাম ও অদম্য ইচ্ছাকেই মূল কারণ নয় বললেন ডা. আল-মামুন। নানা বিপদে স্থানীয়দের এবং কলেজের অবদানের কথাকে ভুলেননি তিনি।
তিনি বলেন, মনে পড়ে এসএসসি পরীক্ষার সময় বোর্ডের ফিস দেয়ার সামর্থ ছিল না আমার। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু টাকা জোগার করতে পারছিলাম না। এসময় আমাদের উপজেলার চেয়ারম্যান এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি সে ফিসের টাকা দিয়ে দিলেন। আমি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। গোল্ডেন এ+ পেলাম। শিক্ষকরা এমন রেজাল্টে খুব খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কারণ অন্যান্যদের মতো প্রাইভেট পড়তে পারিনি। শ্রদ্ধেয় স্যাররা ফ্রি পড়িয়েছেন আমাকে। স্যারদের প্রতি আমি সব সময় কৃতজ্ঞ।
নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা বলতে গিয়ে ডা. আল মামুন বলেন, ছোটবেলা হতেই অনেক প্রতিকূলতার মাঝে, অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখাপড়া চালিয়ে এসেছি। ২ ভাই ও ২ বোনের মাঝে আমিই বড়। দায়িত্বটাও তাই অনেক। বাবা রিকসাচালক হলেও আমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। তার সেই স্বপ্ন পূরণে হাইস্কুল জীবনে কত দিন যে ভ্যান চালিয়েছি, মানুষের বাড়িতে কামলা খেটেছি তার হিসাবটা হয়তো মেলাতে পারব না আজ। বাবা আমার পড়াশোনার জন্য সাধ্যমতো কষ্ট করেছেন। মানুষ অনেক কথাই বলেছেন, তবুও বাবা দমে যাননি।
ডা. আল মামুন বলেন, পড়ালেখা আর রান্ন-বান্নাসহ ঘরের কাজ; দুটোই করতে হতো আমাকে। ৫ম শ্রেণীতে পড়ার সময় হঠাৎ মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতে রান্না হতে শুরু করে ছোট ভাই বোনদের লালন পালনের দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হতো তখন থেকে। মা প্রায় ৪ বছর অসুস্থ ছিলেন। তাই মা-বাবা মাঝেমধ্যে আমাকে বলেন, তাদের ছেলে এবং মেয়ে, দুটাই আমি।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জের পশ্চিম হাসলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হয় আল মামুনের। এরপর মানিকগঞ্জ সদরের লেমুবাড়ী বিনোদা সুন্দরী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে এসএসসি পাস করেন। এমন রেজাল্টে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তার। দরিদ্র কোটায় বিনা খরচে এইচএসসি সম্পন্ন করেন ঢাকার ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে। এরপর ভর্তির সুযোগ পান ফরিদপুর মেডিকেল কলেজেরর ২০ তম ব্যাচে। সেখান থেকেই আজ তিনি সরকারিভাবে ৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে গেজেটেড হলেন।
চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই ছিল কিনা প্রশ্নে ডা. আল মামুন বলেন, ঠিক তা নয়; সে সময় চিকিৎসক হব এমনটা কল্পনা করিনি। চড়াই উতরাই করে স্বপ্ন পরিবর্তন হতে থাকে আমার। সেই যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, তখন চাইতাম স্কুলের প্রধান শিক্ষক হব। যখন হাইস্কুলে গেলাম তখন চেয়েছি হাইস্কুলের শিক্ষক হব। এভাবেই জীবন এগিয়েছে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না।
তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষার পর ভ্যানে সবজি বিক্রি করে সংসারের খরচ জোগাড় করছিলাম। ফলাফলের দিন শুনলাম গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। আর আমার স্কুল হতে আমার ব্যাচই প্রথম এ + পেল। স্যাররাও খুব খুশি। কিন্তু তখন সবজি বিক্রিতেই মনযোগী। এইচএসসি পড়তে পারব কিনা, কোথায় ভর্তি হবো, কী করব? কিছুই জানি না। এর মাঝে একদিন হঠাৎ গ্রাম সম্পর্কিত এক দাদুর কাছে শুনতে পেলাম ঢাকার ক্যামব্রিয়ান কলেজে গরিব মেধাবীদের ফ্রি পড়াবে। দাদু আমাকে ঢাকা নিয়ে এলেন। সেটাই আমার প্রথম ঢাকায় আসা। ক্যামব্রিয়ান কলেজে নিয়ে গেলেন আমার গ্রাম সম্পর্কীয় এক কাকা। ভর্তি করিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণ বিনা বেতনে ২ বছর পড়ার সুযোগ পেলাম। সেই কাকার বাসায় থেকেই আমি এইচএসসি পড়েছি। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। তার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না।