অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শৈথিল্যে খোয়া যাচ্ছে আমানতকারীর অর্থ
ভূইয়া আসাদুজ্জামান / লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :
চেক জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের ১১ কোটি ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তা মো. ইফতেখারুল কবিরের বিরুদ্ধে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) প্রায়োরিটি ব্যাংকিং ম্যানেজার পদে নিয়োজিত থাকাকালে ব্যাংকেরই আরো সাত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে তিনি এ জালিয়াতিতে লিপ্ত হন। চলতি বছরের অক্টোবরে ইবিএলের দুই ব্যবস্থাপকসহ আটজনের বিরুদ্ধে আটটি মামলা করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর দায়ের করা এসব মামলার প্রতিটিতেই আসামি করা হয়েছে ইফতেখারুল কবিরকে। বাকি আসামিরা হলেন সামিউল সাহেদ, জাকির হোসেন, মাহমুদুল হাসান, আবদুল মাবুদ, ফারজানা হোসেন, আজম চৌধুরী ও খালেদ সাইফুল্লাহ।
এসব মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগে ইফতেখারুল কবির ইস্টার্ন ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখায় কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি চান্দগাঁও শাখায় দায়িত্ব পালন করেন।
দুদকের মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে গ্রাহকের কাছ থেকে আগে থেকে রেখে দেয়া চেক জালিয়াতি করে নগদায়ন করে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া গ্রাহকের স্বাক্ষর জাল করে চেক বই ইস্যু করেও টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এর আগে গত ৬ অক্টোবর এফডিআরের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের ৮১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইফতেখারুল কবিরসহ দুজনের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে দুদক।
ব্যাংক ও গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়মের ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগের সংখ্যা সাম্প্রতিক কালে বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের আমানতের অর্থ কর্মকর্তারাই সরিয়ে ফেলছেন বলে অভিযোগ উঠছে। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, ভুয়া হিসাব খুলে অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
গ্রাহকের স্বাক্ষর জাল করে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) বনানী শাখার প্রিভিলেজ সেন্টারের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট জাহিদ সারোয়ারের বিরুদ্ধে। এ টাকা আত্মসাতে নিজের স্ত্রীর সহায়তা নিয়েছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানে সম্প্রতি এ অভিযোগের সত্যতা বেরিয়ে আসে। পরে ১০ ডিসেম্বর দুদকের ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে জাহিদ সারোয়ার ও তার স্ত্রী ফারহানা হাবিবকে আসামি করে একটি মামলা করেন সংস্থার সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ট্রাস্ট ব্যাংকের গ্রাহক ফেরদৌসী জামানের সই জাল করে ব্যাংকের নথিতে থাকা গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে নিজের একটি নম্বর ঢুকিয়ে দেন জাহিদ সারোয়ার। ওই নম্বর ব্যবহার করে ফেরদৌসী জামানের সই জাল করে চারটি চেকবই সংগ্রহ করেন তিনি। এর মধ্যে তিনটি চেকবই গ্রাহককে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন তিনি। ওই তিনটি চেকবইয়ের ৬০টি পাতায় হিসাবধারী ফেরদৌসী জামানের স্বাক্ষর ও ১৬টি পাতায় গ্রাহকের বেয়ারার মো. ইশতিয়াক হোসেন তালুকদারের সই জাল করে ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে নেন জাহিদ সারোয়ার।
পরে ওই টাকার মধ্যে ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্র্যাক ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় স্ত্রী ফারহানা হাবিবের মালিকানাধীন আশা ক্রিয়েশনের নামে সংরক্ষিত ব্যাংক হিসাবে জমা করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন আত্মসাতের অর্থ দিয়ে দেশেই জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি কিনে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ আবার বিদেশেও পাড়ি জমাচ্ছেন। ফলে অনিয়মে অনেকেই উৎসাহীত হচ্ছেন। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়তে দেখা গেছে বলে মনে করছেন তারা। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুর্বলতাকে। দায়ী করা হচ্ছে ব্যাংকগুলোর দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত নিরীক্ষার অভাবকেও।
তারা মনে করছেন, আর্থিক খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। মূলত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবেই খাতটিতে দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। কিছুদিন বন্ধ থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে নতুন করে আরো বড় দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে।
বিশেষ করে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নানা অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাওয়ায় নিম্ন বা মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে। ফলে এসব দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্মকর্তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের আশঙ্কাও বাড়ছে।
আর্থিক সংশ্লিষ্টতাসহ ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন দুর্নীতির যেসব অভিযোগ দুদক অনুসন্ধান করে তার একটি বড় অংশ মামলা পর্যন্ত গড়ায় না। আবার বেশকিছু অভিযোগে মামলা দায়ের হলেও তদন্ত প্রতিবেদনের দুর্বলতায় মূল অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে যায়। দুদকের কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই এত সবকিছুর পরও ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না।
দুদকের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, আর্থিক খাতের বিভিন্ন জালিয়াতির ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করে দুদক। অনুসন্ধানে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললেই দায়ের করা হয় মামলা। এরপর তদন্ত করে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
তারপর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন আদালত। আদালতে গিয়েই মামলা থমকে যায়। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে দুদকেরও অনেক সময় দেরি হয়। অভিযুক্তরাও নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করে। তবে দুদকের দায়ের করা মানি লন্ডারিং মামলার সবগুলোতেই দায়ীদের শাস্তি হয়েছে, যাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা।