করোনায় দান নয়; উপহার পৌঁছে দিচ্ছেন সাত যুবক
এস এম আলাউদ্দিন আল আজাদ আলিফ, নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সচিত্র মৈত্রী
সারাবিশ্বে মুখে মুখে যে ভয়ংকর ভাইরাসের নাম, সেই করোনা মানুষকে শুধু গৃহবন্দী করেই ক্ষান্ত হয়নি। কোভিড-১৯ নামের এই রোগটি শারীরিকভাবে মানুষকে বিপর্যস্ত করার ভীতিতে রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও পঙ্গু করে দিয়েছে। যার দুই পা ছিল, সে না হয় এক পা হারিয়েও সংসারের হাল ধরতে পারে। কিন্তু যার কর্মঠ দুই পা এবং হাত অদৃশ্য শিকলে বন্দী হয়ে গেছে তার কি হবে? বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। কর্মহীন এই অলিখিত লকডাউনের প্রভাব থেকে মুক্ত নয় পার্বত্য জনপদ বান্দরবানও। তবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সমাজের দায়িত্বশীল লোকেরাও বসে নেই। যার যেই সামর্থ্য, তা নিয়েই তারা অসহায় এবং কর্মহীন মানুষের সেবা করে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বান্দরবানে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এই শহরের সাত যুবক। ত্রাণ বা দান নয়, সামর্থ্যহীনদের পাশে দাঁড়ানোর সহযোগিতায় তারা দিচ্ছেন উপহার সামগ্রী।
সংকটের মুখোমুখি পাহাড়ী জনপদ বান্দরবানের পর্যটন শিল্পসহ স্থানীয়দের ব্যবসা বাণিজ্য। কর্মহীন হয়ে পড়েছে এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্প এবং ব্যবসা বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল খেটে খাওয়া মানুষেরা। মূলত যারা অভাবে থেকেও লোকলজ্জার জন্য হাত পাততে নারাজ, তাদেরকে সহায়তা করতেই আইনজীবী ইকবাল করিম সমমনা বন্ধুদের কাছে পরামর্শ চান। যুগান্তর প্রতিনিধি আলাউদ্দিন শাহরিয়ারের কর্মস্থলে ২৯ মার্চ তারা সাতজন প্রথম বৈঠকে মিলিত হন। সেখানেই নিজেদের উপার্জিত অর্থ দিয়েই যাত্রা শুরু হয় ‘করোনা স্বেচ্ছাসেবক- বান্দরবান’ গ্রুপের।
করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিতেই পার্বত্য এই অঞ্চলে অসহায় মানুষদের সহায়তায় সরকারি এবং বেসরকালি অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিভাবে সত্যিকারের অভাবী মানুষকে খুঁজে বের করলেন এই প্রসঙ্গে ফেসবুক ‘করোনা স্বেচ্ছাসেবক- বান্দরবান’ গ্রুপের সমন্বয়ক ইকবাল করিম বলেন, সমাজে গরীব এবং অসহায় লোকদের সাহা্য্য সহজে মিলে। বিত্তবানরাও এদের দিয়ে খুশি হন। কারণ গরীব লোকদের পেতে কষ্ট করতে হয় না। আমরা প্রথমেই যারা নিয়মিত সাহায্য পাচ্ছেন তাদের তালিকাগুলো সংগ্রহ করি। এদের বাদ দিয়ে আমরা এলাকায় এলাকায় অসহায় মানুষদের খুঁজে বের করতে ফেসবুকে পোস্ট দেই। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়েরা দ্রুত আমাদের লিস্ট করতে সহায়তা করেন। আমরা এই লিস্টগুলো পুণঃতদন্ত করার ব্যবস্থা করি। এরপরে আমরা কিভাবে সহায়তা করতে পারি তার পরিকল্পনা করি।
দুর্যোগকালীন সময়ে অসহায় মানুষের পাশে থেকে কিভাবে কাজ করতে হয় সে বিষয়ে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঢাকাস্থ পিপলস ওপেন রোভার স্কাউট লিডার শাহ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো এই অঞ্চলের মানুষরা যথেষ্ট সামাজিক। সমাজের যেকোন প্রয়োজনে তারা এগিয়ে আসতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। শুধু দরকার একটা প্লাটফর্মের। আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং সেই হাতের দেয়া উপহার সঠিক মানুষকে পৌঁছে দিতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই গ্রুপটি তৈরি করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় আমি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এর অ্যাডজুটেন্ট ছিলাম। সেখান থেকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার সুফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করেছি। এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আমার সমমনা বন্ধুদের সাথে মিলে একটি তহবিল গঠন করতে সক্ষম হই। সমাজের সর্বস্তর থেকেই আমরা বিপুল সাড়া পাই।
ফেসবুকে গ্রুপ তৈরি করার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় স্থানীয় ৮০০ এর বেশি মানুষ এই কর্মযজ্ঞের সাথে যুক্ত হন। বিভিন্ন পেশার স্থানীয় যুবকরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সবার অংশগ্রহণে ‘করোনা স্বেচ্ছাসেবক- বান্দরবান’ গ্রুপের পরিকল্পনা অনুসারে ওয়ার্ড ভিত্তিক লিস্ট তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বান্দরবান সরকারি কলেজের প্রভাষক মেহেদী হাসান বলেন, লোকলজ্জায় হাত পাততে পারেন না এমন মানুষের সংখ্যা এই অঞ্চলে নেহায়েত কম নয়। তবে এদের শণাক্ত করা কঠিন কাজ। তাদের আত্মসম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা ইতোমধ্যে ৫০০ পরিবারের কাছে ভালোবাসার হাতবদল করে খাদ্যসামগ্রী উপহার হিসেবে পৌঁছে দিয়েছি। আমরা আরো ২ হাজার পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছি।
সঠিক তথ্য মানুষের কাছে উপস্থাপিত হলে দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। যোগাযোগের এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অনলাইন গণমাধ্যম ‘খোলা চোখ’ এর সম্পাদক ফরিদুল আলম সুমন বলেন, হিসেবের বেলায় আমরা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছি। প্রতিদিন যে পরিমাণ সহযোগিতা পাচ্ছি তার তালিকা গ্রুপেই প্রকাশিত হচ্ছে। আর যাদেরকে আমরা উপহার পৌঁছে দিচ্ছি তাদের ছবি বা নাম আমরা কোথাও ব্যবহার করছি না। এতে পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ণ থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।
প্রথম পর্যায়ে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ , লবণ, তেল দিয়ে উপহার সামগ্রীর প্যাকেট প্রস্তুত হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে উপহার সামগ্রীতে পরিবর্তন এসেছে বলে জানান সংবাদকর্মী আলাউদ্দিন শাহরিয়ার। তিনি বলেন, সরকারিভাবে যেহেতু চাল দেয়া হচ্ছে তাই আমরা এবার থেকে চিড়া, চিনি, লবণ, আলু, পেঁয়াজ দিয়ে আমাদের উপহার সামগ্রী প্রস্তুত করছি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে অন্যান্য সাহায্য লাগলেও গ্রুপ এডমিনদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা পদক্ষেপ নিবো।
তবে শুধু ফেসবুকেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন নি ‘করোনা স্বেচ্ছাসেবক- বান্দরবান’ গ্রুপ। প্রচারণা বৃদ্ধি করতে নেয়া পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানান সিটিজেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের আহবায়ক মো. আমজাদ হোসেন। আমাদের সংগঠন সর্বদা মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কাজ করে গিয়েছে। পাশাপাশি যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন না তাদেরকে লিফলেটের মাধ্যমে আমরা সহযোগিতার আহবান করি। ইউটিউব চ্যানেলেও দেয়া হয় সহযোগিতার আহবান। মোটকথা সমাজের মানুষদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ জাগাতে আমরা যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ব্যবহার করি। আর অল্প সময়ে এর সুফলের কথাও উল্লেখ করেন গ্রুপের এই এডমিন।
উপহার সামগ্রী ঠিক সময়ে গ্রহীতাদের কাছে পৌঁছে দিতে এই গ্রুপকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করেন বিডিক্লিন নামের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মপ্রয়াস সম্পর্কে গ্রুপের এডমিন ওয়েস্টার্ন প্রদর্শনী কেন্দ্রর স্বত্তাধিকারী রাজেশ দাস বলেন, সবার একান্ত সহযোগিতা ছাড়া এত কম সময়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। ইতোমধ্যে আমরা বান্দরবান পৌরসভা এবং সদর উপজেলা পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছি। ভবিষ্যতে বান্দরবানের সাত উপজেলাতেই আমাদের কার্যক্রম পরিচালনার ইচ্ছে রয়েছে। আর শুধু করোনার এই সংকটসময় সময়েই নয়, ভবিষ্যতেও সমাজের প্রয়োজনে যেকোন মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে আমরা বদ্ধ পরিকর।
বান্দরবানের লোকলজ্জায় অভাবী লোকদের সহায়তার হাত বাড়াতে ০১৮১৮২২২১৫৫ নাম্বারে ‘বিকাশ’ এব্ং ০১৭১১০৫৫৮০২ ‘নগদ’ মাধ্যমে সহযোগিতা পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। সবার সহযোগিতায় করোনা প্রতিরোধ করে আমরা আবার সুখী সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে পারবো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ‘করোন স্বেচ্ছাসেবক-বান্দরবান’ গ্রুপের সাত এডমিন।
মৈত্রী/ এএ