ভূরুঙ্গামারীতে দুধকুমার নদীর ভাঙ্গনে অসহায় মানুষ

আসাদুজ্জামান খোকন, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।

কুড়িগ্রাম : ভূরুঙ্গামারীতে নদী ভাঙ্গনে দু’টি গ্রামের দেড় শতাধিক বসতবাড়ি, শতশত বিঘা ফসলি জমি ও ৩টি মসজিদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আরো চার শতাধিক পরিবার, তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি আশ্রয় কেন্দ্র সহ বিস্তীর্ণ জনপদ ভাঙ্গনের হুমকিতে রয়েছে। ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে অচিরেই গ্রাম দু’টি পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। ভাঙ্গন রোধে নিয়মিত নদী খনন ও বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ভাঙন রোধে ৭শ’ ১৪ কোটি টাকার প্রকল্প প্রনয়ণ করা হয়েছে। উপজেলার দুধকুমার, ফুলকুমার, কালজানী, সংকোশ, গঙ্গাধরসহ সবকটি নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। দুধকুমার ও কালজানী নদীর ভাঙ্গনে শিলখুড়ী ইউনিয়নের উত্তর তিলাই, উত্তর ধলডাঙ্গা, দক্ষিণ ধলডাঙ্গা, শালঝোড়, তিলাই ইউনিয়নের খোঁচাবাড়ি, দক্ষিণ ছাট গোপালপুর, শালমারা, নলেয়া, ভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের নলেয়া, চর ভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ইসলামপুর, পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাইকডাঙ্গা গ্রামে ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদী তীরের মানুষজন।

দুধকুমার নদের ভাঙ্গনে পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাইকডাঙ্গা ও চর ভূরুঙ্গামারীর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রাম ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার পথে। গ্রাম দু’টির দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি, কয়েকশো বিঘা ফসলি জমি, গাছ ও বাঁশ বাগান নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় লোকজন তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সড়িয়ে নিচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে দক্ষিণ চর ভূরুঙ্গামারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাইকডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আব্দুল করিম ১৫শ নামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

দশবার নদী ভাঙ্গনের শিকার ইসলামপুর গ্রামের রহিম উদ্দিন ও পাঁচবার নদী ভাঙ্গনের শিকার আব্দুল হালিম জানান, ‘বসত ভিটা সহ সব জমি নদীর পেটে চলে গেছে, এখন তাঁদের মাথা গোঁজার জায়গা নেই।’ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে ইসলামপুর গ্রামের আজিজুল হক ও বিধবা চায়না বেগম সহ অনেকেই তাদের ঘরবাড়ির মালামাল অন্যত্র সড়িয়ে নিচ্ছেন।

ইসলামপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য নফছার আলী জানান, ‘দুধকুমার নদের ভাঙ্গনে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বাড়ি ও ৪০০ বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আরো ২০০ পরিবার হুমকির মুখে রয়েছে। ভাঙ্গনে একটি ঈদ গাঁ মাঠ, একটি মসজিদ ও একটি কবরস্থান বিলীন হয়ে গেছে। অপর একটি ঈদ গাঁ মাঠ, তিনটি মসজিদ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি কবরস্থান ভাঙ্গনের হুমকিতে আছে। ইসলামপুরের ভাঙ্গন রোধে একটি বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান এলাকাবাসী।’

পাইকডাঙ্গা গ্রামের আমির হোসেন, আব্দুস ছালাম, জহির উদ্দিন ও সাবেক মেম্বার আব্দুস সালাম জানান, ‘নদী ভাঙ্গনে পাইকডাঙ্গার প্রায় তিনশো বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।’ ইউপি সদস্য কাবিল উদ্দিন জানান, ‘নদী ভাঙ্গনে পাইকডাঙ্গার প্রায় ৬০টি বাসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া দুইটি মসজিদ, একটি ঈদ গাঁ মাঠ নদী গিলে খেয়েছে। বর্তমানে আরো ২৫০টি পরিবার, দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি আশ্রয় কেন্দ্র হুমকির মধ্যে রয়েছে।’

পাইকডাঙ্গা আব্দুল করিম ১৫শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সাত্তার জানান, ‘নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে বিদ্যালয় দু’টি অল্প সময়ের মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ভাঙ্গন রোধে নদী ড্রেজিং ও বাঁধ নির্মাণের আবেদন জানান তিনি।’

অপরদিকে কালজানী নদীর ভাঙ্গনে শালঝোড় ঘাট সংলগ্ন বাজার, বসতভিটা, আবাদি জমি, গাছের বাগান ও বাঁশবাগান নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। হুমকির মুখে রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

ভূরুঙ্গামারী ও তিলাই ইউপি চেয়ারম্যানগণ জানান, তাঁদের ইউনিয়নে ঘর-বাড়ি ভাঙ্গেন সংখ্যা কম হলেও শতশত জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

ভাঙ্গন কবলিত শিলখুড়ী, চর ভূরুঙ্গামারী ও পাইকেরছড়া ইউপি চেয়ারম্যানগণ জানান, ‘পানিতে তলিয়ে যাওয়া নিম্নাঞ্চল জাগতে শুরু করার সাথে সাথে নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। নদী ভাঙ্গনের শিকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে কাজ করে যাচ্ছি। ভাঙ্গন কবলিত মানুষের জন্য দ্রুত সরকারী সহযোগিতা প্রয়োজন।’

উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান ও দুধকুমার নদ ভাঙ্গন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি শাহানারা বেগম মীরা জানান, ‘জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। নাগেশ্বরী উপজেলার নুন খাওয়া থেকে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার শিলখুড়ী ইউনিয়ন পর্যন্ত একটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস প্রদান করেছে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরুজুল ইসলাম জানান, ‘নদী ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ঢাকায় একটি প্রস্তাবনা প্রেরণ করেছে।’

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, ‘ভাঙ্গন রোধ ও নদী শাসনের জন্য প্রায় ৭শ’ ১৪ কোটি টাকার “দুধকুমার নদী ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন প্রকল্প” নামের একটি প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি একনেকে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে নদী তীরবর্তী মানুষ ভাঙ্গনের কবল থেকে মুক্তি পাবে।

মৈত্রী/এফকেএ/এএ

শেয়ার করুন: