লামায় আশার আলো জাগিয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর নিরাপদ প্রসূতি সেবা

মো. নুরুল করিম আরমান, লামা প্রতিনিধি

বান্দরবান : প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার প্রায় দেড় লাখেরও বেশি পাহাড়ি বাঙ্গালী মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র ভরসা লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। নানা জটিলতা, অপারেশন থিয়েটারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসকের অভাবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটিতে ছিলনা কোন ধরনের অপারেশন কার্যক্রম। ফলে প্রতিনিয়ত ব্যাহত হয়ে আসছিল স্বাস্থ্য সেবা। সবচেয়ে বেশি বেহাল দশার সৃষ্টি হয় প্রসূতি সেবার। প্রতিনিয়ত চরম বিপাকে পড়তে হয় হাসপাতালে আসা প্রসূতিদের। সম্প্রতি এতে যোগ হয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, লোকবল ও যন্ত্রপাতি। এতে সংকট কাটিয়ে বিশেষ করে সচল হয়েছে প্রসূতী মায়েদের জন্য অপারেশন থিয়েটার। শুরু হয় গর্ভবর্তীদের নরমাল ও সিজারিয়ান ডেলিভারি কার্যক্রম। যা বর্তমানে উপজেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে। প্রসূতি সেবা দানে এই কেন্দ্রটি আজ অনন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। আর বেসরকারী ক্লিনিকে গিয়ে সিজার না করে সরকারী এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতি আস্থা বাড়ছে ডেলিভারি রোগী ও প্রসূতি মায়েদের। এখানে সর্বোচ্চ সেবা পেয়ে প্রসূতি মা ও স্বজনেরা এখন বেজায় খুশি। গত নভেম্বর মাস থেকে রেকর্ড সংখ্যক গর্ভবর্তী মায়ের সফল ডেলিভারি সম্পন্ন হয় এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। যা তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে প্রথম। এ পরিসংখ্যান থেকেই উঠে আসে বর্তমানে প্রসূতি নারীদের জন্য কতোটুকু নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। সব মিলিয়ে কয়েক যুগ পর হলেও অবশেষে আলোর মুখ দেখেছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। সাফল্যের জোয়ারে ভাসছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ও নার্সরা।

জানা গেছে, ৫০ শয্যবিশিষ্ট লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি বিভিন্ন অনিয়ম, অবহেলা ও প্রয়োজনীয় লোকবলসহ যন্ত্রপাতির অভাবে ভোগান্তির শেষ ছিল না এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। সামান্য জটিলতা দেখা দিলেই কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হত রোগীকে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে এ প্রচলন ছিল বেশি। যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসক সংকট কাটিয়ে গত নভেম্বর মাস থেকে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শুরু হয় গর্ভবর্তী মা’দের ডেলিভারি কার্যক্রম। সে মতে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চালু হওয়ার সাথে সাথে জরুরী প্রয়োজনে নভেম্বর মাসে ২জন ও ডিসেম্বর মাসে ১৪জন মা’কে নিরাপদ অস্ত্রোপচার করে সন্তান ডেলিভারি করাতে সক্ষম হয়। ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসে নরমাল ডেলিভারী হয় ২৬টি ও সিজারিয়ান ডেলিভারি হয় ৩টি। ফেব্রুয়ারী মাসে নরমাল ২৯টি ও সিজারিয়ান ডেলিভারি হয় ৪টি। সর্বশেষ ৪ মার্চ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সর্বশেষ শুক্রবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয় ৪ জন ডেলিভারি রোগী। কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরেও নরমাল ডেলিভারি না হওয়ায় শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা এ ৪জন গর্ভবর্তী মায়ের সিজারিয়ান ডেলিভারি সম্পন্ন হয়। প্রসূতিরা মায়েরা হলেন- লামা পৌরসভার বাজার পাড়ার মিনা বড়–য়া, কলেজ গেইট পাড়ার আমেনা বেগম, পাশের চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের মাটিয়াটিলার রাজিয়া বেগম (২৮) ও বমুরকুল পাড়ার মাজেদা আক্তার (২৮। নারমাল ডেলিভারির চেষ্টা করেছি কিন্তু সম্ভব না হওয়ায় সিজার করতে হয়েছে। সফল ডেলিভারির পর মা ও নবজাতকরা সবাই ভালো আছেন বলে জানান, দায়িত্বরত চিকিৎসক এনেস্থেশিয়া কনসালটেন্ট নূর মুহাম্মদ।

এ ডেলিভারি অপারেশন পরিচালনায় রয়েছেন- গাইনী কনসালটেন্ট ডা. মাকসুদা বেগম, এনেস্থেশিয়া কনসালটেন্ট ডা. নূর মুহাম্মদ, সহাকারী সার্জন ডা. আতিয়া সুলতানা লাকি, সিনিয়র নার্স ইখেনু মার্মা সিনিয়র স্টাফ নার্স ও মিডওয়াইফ নার্স শাহিনা বেগম, ইখেনু, জান্নাতুল ফেরদৌস, রেবেকা পারভিন, আরজিনা ও মিজবা। সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহিনা বেগম, জান্নাতুল ফেরদৌস ও মিডওয়াইফ মিজবা জানান, এখানে ২৪ ঘণ্টা নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। যখনই প্রসূতি আসেন, তখনই সেবা দেওয়া হয়। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কলাণ কেন্দ্রে গুলোতেও গর্ভবর্তী মাদের নরমাল ডেলিভারি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।
প্রসূতি রাজিয়া বেগমের অভিভাবক শফিকুর রহমান জানায়, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রসূতি মাদের নরলাম ও সিজারিয়ান ডেলিভারি কার্যক্রম চালু হওয়ায় আমরা সাধারণ মানুষ সরকারী চিকিৎসা সেবার প্রতি আস্থা ফিরে পেয়েছি। এত আন্তরিকতার সহিত যে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় তা আমার জানা ছিলো না। শুক্রবার সকালে স্ত্রী ফাতেমা আক্তারের প্রসবজনিত ব্যাথা শুরু হলে লোকমুখে শুনে স্ত্রীকে নিয়ে লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটে যান আইয়ুব আলী। দ্রুত এই কেন্দ্রে গেলে শনিবার নিরাপদে একটি ছেলে সন্তান জন্ম হয় আইয়ুব আলীর।

এ বিষয়ে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মইনুদ্দীন মোর্শেদ বলেন, নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না হওয়ায় প্রসূতির স্বজনদের সম্মতিক্রমে আমরা সিজারের ব্যবস্থা করি। শনিবার ৪জন গর্ভবর্তী মায়ের সফলভাবে সিজার সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে প্রসূতি মায়েদের জন্য এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরো জানান, ডেলিভারি মায়েদের জন্য সার্বক্ষণিক দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত ডাক্তার এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ নার্স রয়েছেন। রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড, মিডওয়াইফদের আলাদা ডিউটি রুম, সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা এবং আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে ক্রমেই ডেলিভারি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৫ মার্চ পর্যন্ত ৮২ জন নরলাম ও সিজারিয়ান ডেলিভারি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। বিশেষ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে প্রসবের উদ্যোগটি সফলতা নিয়ে এসেছে বলেও জানান তিনি।

প্রসূতি সেবা চালু করায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের ভূয়শী প্রশংসা করে লামা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা জামাল ও পৌরসভা মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে প্রসূতি মায়েদের জন্য এ ধারা অব্যাহত রাখার আহবানও জানান এ দুই জনপ্রতিনিধি।

মৈত্রী/এফকেএ/এএ

শেয়ার করুন: