রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে ইহা লইয়া প্রচুর আলোচনা চলিতেছে। এই সমস্যাকে কেন্দ্র করিয়া বিভিন্নমুখী চিন্তাধারার প্রকাশ হইতেছে… প্রধানত বাংলা ও উর্দুকে লইয়াই এখন বিতর্কের উদ্ভব হইয়াছে এবং প্রকৃতপক্ষে অন্য কোন ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইতে পারে না। …এই জন্যই প্রথমেই রাষ্ট্রীয় ভাষার উপযোগী গুণাবলী নির্ণয় প্রয়োজন।
নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার আসন পাইবার উপযুক্ত বলিয়া মনে করা যাইতে পারে:১) ভাষাভাষীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় হইলে চলিবে না। ২) দুই ভাষাভাষীর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে। ৩) এই ভাষার মাধ্যমে ইসলামের ভাবধারাকে ভাষাভাষীর মধ্যে পরস্ফুিট করিয়া তুলিতে হইবে। ৪) এই ভাষার ব্যাকরণ, বর্ণমালা ও লিপি জটিলতা বর্জিত হইবে।
পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলিয়া থাকে:সুতরাং উপরোক্ত আদর্শে বাংলার দাবিই অগ্রগণ্য। …উর্দু ভাষাভাষীর সংখ্যাও বাংলার তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। …সুতরাং এইদিক হইতে বিচার করিলে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হইবার কোন দাবিই যুক্তিযুক্ত হয় না।
…নিরপেক্ষভাবে বিচার করিলে ইংরেজি ভাষার দাবি অবশ্যই অগ্রগণ্য, কারণ এতদিন রাজনীতির ক্ষেত্রে ইংরেজিরই প্রাধান্য ছিল। তবে বৈদেশিক কোন ভাষাই কোন রাষ্ট্রেরই রাষ্ট্রীয় ভাষা হইতে পারে না…। সুতরাং উর্দু এবং বাংলার দাবিই মাত্র এখন আমাদের বিচার্য। কিন্তু উর্দুও যে প্রকৃতপক্ষে এই দেশীয় ভাষা এই কথাও বলা চলে না। উর্দু হইল তুর্কী শব্দ— এর মানে ‘শিবির’। সৈন্যদের মধ্যে আলোচনার সুবিধার্থে সম্রাট আকবর এই ভাষার উদ্ভাবন করেন— শিবিরজাত বলিয়াই এই ভাষার এই নাম। সুতরাং দেখা যাইতেছে, উর্দু ভাষা প্রকৃতপক্ষে দেশের ভাষা নয়। বিভিন্ন দেশীয় শব্দভাণ্ডার হইতে চয়ন করিয়া এই ভাষার শব্দ সম্ভার সমৃদ্ধিশালী করা হইয়াছে।
…আবার কেহ কেহ এই ভাষাকে মুসলমানী ভাষা হিসাবে দাঁড় করাইয়া ইহাকে রাষ্ট্রভাষারূপে চালাইতে চেষ্টা করিতেছেন। এই প্রচেষ্টা যে নিতান্তই ভাবপ্রবণতা, একথা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। কারণ, প্রথমত: মুসলমানী ভাষা বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ভাষার অস্তিত্ব নাই। …ইহা হইতে পারে যে, ইসলামের শিক্ষা, সংস্কৃতি যে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাকেই মুসলমানী ভাষা বলা চলে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মতে আরবি ভাষাকে একমাত্র মুসলমানী ভাষা বলা যাইতে পারে।