মাছের উৎপাদন বাড়াতে জলাশয়গুলোকে আগের অবস্থায় আনা হবে : প্রধানমন্ত্রী
গোলাম রব্বানী,
লিগ্যাল ভয়েস ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের আমিষের চাহিদা পূরণে দেশের জলাশয়গুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যেই আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি- আমাদের যত জলাশয়, পুকুর, খাল, বিল রয়েছে সেগুলোকে আমরা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনবো। যাতে করে আমাদের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে।’
বাড়ির আশপাশের ডোবা, পুকুর ও জলাশয়কে ফেলে না রেখে মাছ চাষ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা খাদ্যের চাহিদা পূরণ করেছি। এখন দৃষ্টি পুষ্টির দিকে। বিল, ঝিল, হাওর, বাওড়, নদী নালায় পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ করতে হবে। মাছের চাইতে এত নিরাপদ আমিষ আর নেই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীর ফার্মগেটে বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে (কেআইবি) জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০১৯’র উদ্বোধনকালে একথা বলেন।
তাঁর সরকারের শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নদী মাতৃক বাংলাদেশে আমরা নদীগুলোকে ড্রেজিং করছি যাতে করে এর প্রবাহ এবং নাব্যতা বৃদ্ধি পায়। আর পানির প্রবাহ বাড়লে মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যেকোন দুর্যোগের মোকাবেলা আরো সহজ হবে।’
অনুষ্ঠানে মৎস্য চাষ, রেণু উৎপাদনসহ মৎস্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতীয় মৎস্য পুরস্কার ২০১৯ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী।
পুরস্কার হিসেবে ৮ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ পদক ও ৫০ হাজার টাকার করে চেক এবং ৯ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে রৌপ্য পদক ও ৩০ হাজার টাকার করে চেক প্রদান করা হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রইসুল আলম মন্ডল অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। একই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সাইদ মোহম্মদ রাশিদুল হক এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
‘মাছ চাষে গড়ব দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ শীর্ষক স্লোগান নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারেও দিবসটি পালিত হচ্ছে।
পরে প্রধানমন্ত্রী কেআইবি প্রাঙ্গণে সপ্তাহব্যাপী জাতীয় ‘মৎস্য মেলা’র উদ্বোধন করেন। এই মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে দেশের সকল জেলাতেও মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা গণভবনের লেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পোনা মাছ ছেড়ে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন অভিযানের সূচনা করেন। তিনি সে সময়ই পাট, চামড়া, চা-এর সঙ্গে মাছকেও বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, পরিকল্পিতভাবে মাছ উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে তা বিদেশেও রফতানি করা যায়। এ জন্য মাছের উৎপাদন বাড়ানোর এবং কোয়ালিটি সম্পন্ন মৎস্য বিদেশে রফতানি করার জন্য আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।
তাঁর সরকার জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসৃজন, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘জলমহালে প্রকৃৃত জেলেদের অধিকার নিশ্চিত করতে নতুন জলমহাল নীতিমালা, জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘হ্যাচারি আইন ও বিধিমালা, মৎস্য খাদ্য ও পশুখাদ্য আইন ও বিধিমালা প্রণয়নসহ অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘চিংড়ি প্লান্ট ইজারা নীতিমালা, মৎস্য সঙ্গনিরোধ আইন ও জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, এ সকল আইন, বিধি ও নীতিমালা প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্যই হল মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও ভোক্তা সাধারণের জন্য মানসম্পন্ন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, ‘জাল যার জলা তার’ আমরা এর ভিত্তিতে জেলেদের বিভিন্ন জলাশয় বরাদ্দ দিচ্ছি। সেখানে তারা মৎস্য উৎপাদন করে আমাদের চাহিদা মেটাচ্ছে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমরা বাগেরহাটে চিংড়ি গবেষণা, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ ও গোপালগঞ্জে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছি। যেন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, সেজন্য হাওড়ে পরিকল্পিতভাবে মৎস্য চাষের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১০ বছরে মাছের উৎপাদন ৫৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। একে ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করাই আমাদের লক্ষ্য।’
মিঠা পানির মৎস্য উৎপাদনে আমরা তৃতীয় স্থানে রয়েছি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামীতে আমরা যেন প্রথম স্থান লাভ করতে পারি, মিঠা পানির মৎস্য চাষে আমাদের লক্ষ্য থাকবে প্রথম স্থান অর্জন করার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘আর সেকারণে এখন থেকেই তাঁর সরকার খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।’
চিংড়ি, মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ’৯৬ সালে সরকার গঠনের সময় বিদেশে চিংড়ি রপ্তানী বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে এক পুনরায় চালুর ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের উদ্যোগসমূহ তুলে ধরেন। মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের আন্তর্জাতিক মান নিরূপণের লক্ষ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৩টি মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের কথাও জানান তিনি।
সরকার প্রধান বলেন, দেশের জনসংখ্যার ১১ শতাংশের বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্যসম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। প্রাণিজ আমিষের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ যোগান দেয় মৎস্য খাত।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সমস্যা সমাধানের কারণে বিশাল সমুদ্রসীমায় (১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার) বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করে তাঁর সরকারের ব্লু-ইকোনমি সম্প্রসারণের উদ্যোগও তুলে ধরেন।
‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র চিরায়ত পরিচয় ধরে রাখতে প্রাকৃতিক উৎসগুলো রক্ষায় তাঁর সরকার সর্বাধিক গুরুত্বদিবে।