ব্যাংকে ‘লুটপাটে’র কারণ জানতে কমিটি করতে নির্দেশ : হাইকোর্ট
ভূইয়া আসাদুজ্জামান / লিগ্যাল ভয়েস টোয়েন্টিফোর :
ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা তদন্ত করতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ৯ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে বকেয়ার ২ শতাংশ জমা (ডাউন পেমেন্ট) দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুবিধা নেওয়ার জন্য আবেদন করার সময়সীমা আরো ৯০ দিন বাড়িয়ে দিয়েছেন আদালত। তবে পরবর্তীতে ঋণ গ্রহণ করতে হলে ২০১২ সালের জারি করা (ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট-বিআরপিডি) প্রজ্ঞাপনের ৬(এ) ধারা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রবিবার এ রায় দিয়েছেন। গত ২০ বছরে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা তদন্তে কমিশন গঠন ও শতকরা ২ ভাগ ডাউন পেমেন্ট সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল বিষয়ে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় দিলেন।
গত ২৮ অক্টোবর এই রুলের ওপর শুনানি শেষে ৩ নভেম্বর রায়ের দিন নির্ধারণ করেন আদালত। এ অবস্থায় আজ নির্ধারিত দিনে রায় দিলেন হাইকোর্ট।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা এক রিট আবেদনে এ রায় দেন আদালত। আদালতে রিট আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, শামীম খালেদ আহমেদ ও ব্যারিস্টার মুনীরুজ্জামান।
দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক।
ব্যাংক হচ্ছে অর্থ সঞ্চালনের হৃৎপিণ্ড
আদালত বলেন, মানবদেহের রক্ত সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎপিণ্ড। তেমনি অর্থ সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংক। ব্যাংক হচ্ছে অর্থ সঞ্চালনের হৃৎপিণ্ড। আদালত বলেন, গত ২৫ বছরে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে। দেশের শিল্পখাত, বাণিজ্যিক খাত সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক বা বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো চাঞ্চল্যকর আর্থিক কেলেংকারির ঘটনা ঘটেছে। যদিও এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এরইমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই পদক্ষেপ যথেষ্ট নয় বলে মনে করি।
আদালত বলেন, আর্থিক খাতে এ ধরণের অনিয়ম বহাল থাকলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যে পৌছতে সরকার ঘোষিত কর্মসূচি বাধাগ্রস্থ হবে। একারণে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা তদন্তে একটি কমিটি করা দরকার। যে কমিটি হবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে।
সুদের হার এক ডিজিটে নামানো উচিত
আদালত বলেছেন, অধিক হারে সুদ নেওয়ার কারণে এর প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পড়ে। উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যায়। একারণে সুদের হার এক ডিজিটে (সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ) নামিয়ে আনা উচিত।
কর্মকর্তা নিয়োগে তদারকি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক
রায়ে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ ৫ কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া শীর্ষ ৫ কর্মকর্তা নিয়োগ করা যাবে না।
গত ২০ বছরে আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বন্ধে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, শৃঙ্খলা ফেরাতে কমিশন গঠনের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ২৩ জুলাই রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এ ছাড়াও রুলে ২ শতাংশ সুদ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিলের জন্য গত ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপন কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। এই রুল নিষ্পত্তি করে গতকাল রায় দিলেন আদালত।
রবিবার রায়ের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, নয়জন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এই কমিটি সরকারি-বেসরকারি সকল ব্যাংকের দুর্বলতা, বিশেষ করে ঋণ পরিশোধ, ঋণ অনুমোদন এবং সংগ্রহে অনিয়মসহ সব বিষয় তদন্ত করবে। কি কারণে এই দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে তা চিহ্নিত করবে।
একইসঙ্গে এসব সমস্যা দুর করতে সুপারিশ তৈরি করবে। এই কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন দেবে। এই প্রতিবেদন কার্যকর করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুন:তফসিলের বিষয়ে আদালত আদেশ দিয়েছেন যে, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি ঋণ নিতে যায় তবে তার কাছে যে ঋণ পাওয়া যাবে তার ১৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে। ঋণ দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। সিআইবিতে তার নাম পাঠাতে হবে।
তবে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার দিয়েছিলো তা অবৈধ করেননি হাইকোর্ট। বরং ওই সার্কুলারের মেয়াদ আরও তিন মাস সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন।