বেজমেন্টে বিপুল রাসায়নিকের সন্ধান, ঘটনা হতে পারতো আরো ভয়াবহ
চকবাজারের চুড়িহাট্টার মোড়ে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে কেমিক্যালের বিশাল মজুতের সন্ধান মিলেছে। বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে ভয়াবহ আগুনে ওই ভবনের নিচ তলা থেকে সাড়ে চার তলা পর্যন্ত পুরোটা পুড়ে গেলেও বেজমেন্টের গোডাউনে রাখা কেমিক্যালগুলো অক্ষত রয়েছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপরীত পাশে রাজ্জাক ম্যানশনের নিচ তলায় হায়দার ফার্মেসির পেছনের একটি গোডাউনেও কেমিক্যালের মজুত পাওয়া গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, এই দুই গোডাউন পর্যন্ত আগুন পৌঁছালে দুটি ভবনই উড়ে যেত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারতো আরো অনেক বেশি।
ওয়াহিদ ম্যানশনের গুদামে রাখা কেমিক্যালের ড্রামশুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল এই গোডাউনের সন্ধান পায়। এরপর সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গোডাউনটি পরিদর্শন করেন এবং দাহ্য রাসায়নিক পদার্থগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেন।
যদিও বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, ‘চকবাজারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় যে ভবনে আগুন লেগেছে, সেখানে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের (কেমিক্যাল) কোনও অস্তিত্ব নেই এবং কোনও গোডাউনও ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিমতলীর ঘটনা আর চকবাজারের ঘটনা একদম ভিন্ন। এটা কেমিক্যাল সম্পর্কিত কিছুই না। সিলিন্ডার থেকে এটা হয়েছে। আজকের ঘটনা ভিন্ন। এটা কেমিক্যাল সম্পর্কিত কিছুই না। আমি সরেজমিনে দেখে এসেছি। দিস ইজ ডিফারেন্ট স্টোরি।’
ওয়াহিদ ম্যানশনের গুদামে পাওয়া কেমিক্যালের ড্রামমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের একদিন পরই ওয়াহিদ ম্যানশনে কেমিক্যাল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গঠিত তদন্ত কমিটিরও একজন সদস্য। শুক্রবার ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শনে এসে তিনি এ মন্তব্য করেন। জুলফিকার রহমান বলেন, ‘ভবনে অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল। ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল, এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এছাড়া, অন্যান্য কেমিক্যালও ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুনকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমার মতো কাজ করেছে। এগুলো আগুনকে টিগার করেছে, যে কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। কেমিক্যালের কারণেই এভাবে ছড়িয়েছে। না হলে কখনও আগুন এভাবে ছড়ায় না।’
পাল্টাপাল্টি এসব বক্তবের মধ্যেই শুক্রবার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে ও বিপরীত পাশে রাজ্জাক ম্যানশনের নিচতলার একটি গোডাউনে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ভর্তি ড্রামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে কেমিক্যালের মজুত আবিষ্কারের পর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের লালবাগ স্টেশনের কর্মকর্তা রতন কুমার দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কেমিক্যাল গোডাউন পরিদর্শন করে প্রাথমিকভাবে আমরা বেশ কিছু কেমিক্যাল ও দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ পেয়েছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— আয়রন অক্সাইড, আয়েনিক ইয়েলো, আয়েনিক ব্লু, আয়েনিক রেড, অয়েল রেড, এসিড গ্রিন, রেড কালার পিগমেন্ট, ব্লু কালার পিগমেন্ট, ইয়েলো কালার পিগমেন্ট, কার্বন ইনজেনিরিয়াড। গুদামে আয়ন অক্সাইডের ছোট ছোট অনেকগুলো ড্রাম রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই কাগজের মোড়কে মোড়ানো ছিল। এসব কেমিক্যাল বিভিন্ন রংয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এই গোডাউনে কোনোভাবে যদি আগুন ঢুকতে পারতো, তাহলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারতো। এতে পুরো ভবনটি ধ্বসে পড়ে যেত। এছাড়া, আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক বেশি বেগ পেতে হতো। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।’ তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান রতন কুমার দেবনাথ।
রাজ্জাক ভবনের গুদামে রাখা কেমিক্যালফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের আন্ডার গ্রাউন্ডে কোনও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই। বাতাস বের হওয়ার কোনও জায়গা নেই। এই অবস্থায় এখানে ভবন মালিক কেমিক্যাল গুদামজাত করেছেন। ভবনের বেজমেন্টে মালামাল গুদামজাত করা আইনত অপরাধ। সেখানে গাড়ি পার্কিং করা যাবে। কিন্তু এই ভবনের মালিক ও গোডাউন মালিক সব ধরনের আইন ভঙ্গ করেছেন।
শুক্রবার সরেজমিনে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের ওই গোডাউনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, একদিকে সারিসারি বিভিন্ন কেমিক্যালের ড্রাম রাখা। আরেক দিকে রয়েছে আয়রন অক্সাইডের বেশ কয়েকটি ছোট ড্রাম। ভেতরে পুরো বেজমেন্টে কেমিক্যালের ড্রাম ও প্যাকেট গুদামজাত করা ছিল। ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। গোডাউনের কোথাও কোনও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টোদিকে রাজ্জাক ভবনের বিপরীতে পুড়ে যাওয়া হায়দার ফার্মেসির পাশেই একটি সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাম দিকে একটি দরজা। সেই দরজা খুলতেই দেখা গেলো সারিসারি কেমিক্যালের ড্রাম। সঙ্গে থাকা ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানালেন, এই কেমিক্যালে আগুন লাগলে এই ভবন বিস্ফোরণ হতো। আগুনের তীব্রতা বেড়ে যেত আরও কয়েকগুণ। ক্ষয়ক্ষতিও হতো অনেক বেশি।
রাজ্জাক ভবনের গুদামে সংরক্ষিত বিভিন্ন কেমিক্যালের ড্রাম সরেজমিন দেখা গেছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় যে মার্কেট, সেখানেও বেশ কয়েকটি প্লাস্টিক দানার গোডাউন ছিল। আরও ছিল একটি রেফ্রিজারেটর মেরামতের দোকান। এরপাশে ছিল মদিনা ডেকোরেটর। এগুলো সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় পুরো ফ্লোরজুড়ে ছিল বডি স্প্রে, রুম স্প্রে’র বিশাল গোডাউন। সেখানে বিপুল সংখ্যায় স্প্রে’র বোতল গুদামজাত করা ছিল। ভবনের তৃতীয় তলায় একটি কসমেটিক্স ও স্প্রে বোতলের গোডাউন এবং চতুর্থ তলায়ও একটি কসমেটিক্সের গোডাউন ছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন লাগার পর রাতভর এসব স্প্রে ক্যানিস্টারগুলো বোমার মতো ফুটেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় ২০ বছর আগে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন নামের ভবনটি তৈরি করা হয়। ভবনের মূল মালিক হাজী ওয়াহেদের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে হাসান ও সোহেল মালিকানা পায়। তবে সোহেল প্রায় সময়ই চট্টগ্রামে থাকতেন এবং হাসান পরিবার নিয়ে ওই ভবনেই থাকতেন। এই দুই ভাই এবং তাদের পরিবার আগুনের হাত থেকে রেহাই পেলেও তারা বর্তমানে কোথায় আছেন তা জানা যায়নি। ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে কেমিক্যালের এই গোডাউনটি সোহেলের ছিল বলে স্থানীয়রা জানান।তবে গোডাউনটির প্রকৃত মালিক কে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।