‘কুখ্যাত’ হাতি টপসি এবং এডিসনের দায়!

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় যে সকল বিজ্ঞানী সবচে বেশি অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মার্কিন উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন। তিনি গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরা এবং দীর্ঘস্থায়ী বৈদ্যুতিক বাতি (বাল্ব) সহ বহু যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যা বিংশ শতাব্দীর জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এই বিজ্ঞানীর নামে ১ হাজার ৯৩টি মার্কিন পেটেন্টসহ যুক্তরাজ্যে, ফ্রান্স এবং জার্মানির একাধিক পেটেন্ট রয়েছে। গণযোগাযোগ খাতে বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ খাতে তার বহু উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার অবদানের জন্য তিনি সর্বস্বীকৃত।
তবে এসবের মধ্যে এডিসনের সবচেয়ে আলোচিত এবং যুগান্তকারী উদ্ভাবন বাসস্থান, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা কারখানায় বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ও বন্টনের ধারণা এবং প্রয়োগ। এডিসনের এই উদ্ভাবন আধুনিক শিল্পায়নের একটি যুগান্তকারী উন্নতি। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন দ্বীপে তার প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানানো নিয়েই এডিসনকে নিয়ে সমালোচনাও আসে বেশ। এসি ও ডিসি কারেন্ট নিয়ে দ্বন্দ্বে তার ভূমিকাই সমালোচনার মূখ্য কারণ। ঊনিশ শতকের প্রায় শেষদিকে এডিসন ও ওয়েস্টিংহাউস ইলেকট্রিক কোম্পানির মধ্যে বিদ্যুৎ নিয়ে এ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল।

এডিসন ডিসি কারেন্ট ব্যবহার করে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে শুরু করেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিশাল বৈদ্যুতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। কিন্তু ঝামেলা বাঁধায় ওয়েস্টিংহাউস ইলেকট্রিক কোম্পানি। তারা এসি কারেন্ট সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হয় বাজারে। এসি কারেন্ট প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত ছিল বলে মানুষ সেদিকে ঝুঁকতে থাকে। কিন্তু এডিসন এ প্রযুক্তির উৎকর্ষতা স্বীকার না করে এসি কারেন্টের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়াতে লিপ্ত হন।

তিনি বিশ্বাস করতেন, এসি কারেন্ট বিপজ্জনক। এটি প্রমাণ করতে সাংবাদিকদের সামনে কুকুরসহ বেশ কিছু পশু তিনি হত্যা করেছিলেন এসি কারেন্ট দিয়ে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি নিন্দিত হন জনসম্মুখে টপসি নামক একটি হাতিকে হত্যার অভিযোগে। বলা হয়, ‘পাবলিসিটি স্টান্টের’ জন্য সহস্রাধিক মানুষের সামনে টপসিকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে হত্যা করেছিলেন তিনি। এসি কারেন্টের সাহায্যে হাতিটিকে মেরে মানুষকে দেখাতে চেয়েছিলেন এ কারেন্ট কতটা বিপজ্জনক।

কিন্তু টপসির ঘটনায় এডিসনের ভূমিকা কতটা ছিল এ নিয়ে বিতর্ক আছে ইতিহাসবিদের মধ্যে। কে ছিল এই টপসি? কেনই বা জনসম্মুখে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? এডিসন কি আসলেই জড়িত ছিলেন এ হত্যাকান্ডে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করা হবে আজকের লেখায়।

১৮৭৫ সালের দিকে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো এক অঞ্চলে ধরা পড়ে টপসি। তখন সে কেবল বাচ্চা একটি হাতি। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চালান করে দেওয়া হয় তাকে। তার নতুন ঠিকানা হয় ফোরপফ সার্কাস দলে। এ দলটি তখন আকর্ষণীয় হাতির সংগ্রহ নিয়ে প্রতিযোগিতারত ছিল ‘বার্নাম এন্ড বেইলি’ নামে অন্য একটি দলের সাথে।

টপসি সার্কাস দলের শোভা বাড়ালেও এ অভিজ্ঞতা তার নিজের জন্যে সুখকর কিছু ছিল না। তার প্রশিক্ষণের জন্য যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো, বর্তমান সময়ের হিসেবে সেগুলো পশু নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে। প্রচণ্ড পরিমাণ মারধরের ফলে এমনকি তার লেজ পর্যন্ত বেঁকে গিয়েছিল চিরতরে। এর প্রভাব পড়ে তার স্বভাবেও। সময়ের সাথে সাথে ভীষণ রকম বদরাগী হয়ে ওঠে সে। কুখ্যাত হয়ে ওঠে আগ্রাসী স্বভাবের জন্য।

১৯০২ সালের দিকে জেমস ফিল্ডিং ব্লাউণ্ট নামের একজন ব্যক্তি জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা দেয় টপসিকে। তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে লোকটির ওপর আক্রমণ করে বসে সে। মারা যায় ব্লাউন্ট। কিন্তু টপসি এতটাই মূল্যবান ছিল যে এর পরেও শো’র অংশ হিসেবে রেখে দেয়া হয় তাকে। মানুষ খুনের কুখ্যাতি আরো আবেদন বাড়ায় তার।

সেসময় মোটামুটি ‘এনিম্যাল সেলিব্রেটি’ বনে গিয়েছিল সে। কিছুদিন পর তার নতুন ঠিকানা হয় কনি আইল্যান্ডের লুনা পার্কে। নতুন শুরু হওয়া এ বিনোদন পার্কটির অন্যতম আকর্ষণ ছিল টপসি। তবে এখানে এসেও তার ভাগ্য খুব একটা বদলায়নি। তত্ত্বাবধায়কদের হাতে এখানেও বেদম প্রহারের শিকার হতে হয়েছে তাকে। ফলে তার মেজাজ আরো বিগড়েছেই। এখানে আরো দুজন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হয় হাতিটি।

তার কুখ্যাতির মুকুটে সর্বশেষ পালকটি যোগ করে হোয়াইটি অল্ট নামে এক প্রশিক্ষক। অল্ট একবার মাতাল হয়ে টপসিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শহরের রাস্তায়। গোটা শহরশুদ্ধ লোকের মাঝে ভীষণ ভয়-ভীতি ছড়িয়ে পড়ে এ ঘটনায়। যদিও এটি ঘটেছিল সম্পূর্ণ অল্টের দোষে, কিন্তু এর ফলে টপসির দুর্নাম আরো ছড়িয়ে পড়ে।

এ ঘটনার পরে পার্কের মালিকেরা সিদ্ধান্ত নেন, এমন একটি হাতিকে আর বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না। প্রথমে তারা তাকে জনসম্মুখে ফাঁসি দেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু বাধ সাধে ‘সোসাইটি অফ প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলিটি টু এনিম্যালস’ (এস.পি.সি.এ) নামের একটি সংগঠন। ফাঁসি খুবই নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া বলে আপত্তি জানায় তারা। এরপর এস.পি.সি.এ’র সাথে আলোচনা করে টপসিকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন মালিকরা।

১৯০৩ সালের ৪ জানুয়ারি, প্রায় দেড় হাজার দর্শকের সামনে হাজির করা হয় টপসিকে। এর আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে কোনো হাতিকে হত্যা করা হয়নি। তাই তারা নিশ্চিত ছিলেন না স্রেফ বিদ্যুৎ তার মতো একটি হাতিকে হত্যা করতে পারবে কি না। তাই আগে বিষ মেশানো খাবারও খাওয়ানো হয় তাকে।

এরপর বৈদ্যুতিক মরণফাঁদ প্রস্তুত করা হয় টপসির জন্যে। দুটি কপার তার জড়িয়ে দেওয়া হয় তার পায়ে। পাওয়ার সুইচটি অন করতেই ৬,৬০০ ভোল্টের এসি কারেন্ট ছুটে যায় তার শরীরে মধ্য দিয়ে। মুহূর্তেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায় ২৮ বছর বয়সী হাতিটির। ইতিহাসে মানুষের নিষ্ঠুরতার জলজ্ব্যান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিদায় নেয় টপসি।

প্রশ্ন জাগে, এ কাহিনীতে তো এডিসনের ভূমিকা কোথাও দেখা গেল না। তবু এডিসনের ওপর এ দায়ভার কেন চাপানো হয়? এর কারণ মানুষ আসলে টপসির মৃত্যুকে কারেন্টের দ্বন্দ্বের অংশ হিসেবেই ধরে নেন। অনেকে মনে করেন, টপসিকে যখন তার মালিকরা মারার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এ সুযোগটি লুফে নেন এডিসন। এরপর এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, এ ঘটনা তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন পরবর্তীতে প্রচারণা চালানোর জন্যে।

শিল্পীর তুলিতে টপসি হত্যা

এমনটা ভাবার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, টপসির হত্যা প্রক্রিয়ার সাথে এডিসনের কাজের মিল পাওয়া যায়। তিনি এর আগেও এস.পি.সি.এ’র দেওয়া কিছু প্রাণীকে এভাবে হত্যা করেছেন। দ্বিতীয়ত, টপসি হত্যাকাণ্ডে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছিল যেসকল টেকনিশিয়ান, তারা ছিলেন এডিসনের নাম সম্বলিত একটি কোম্পানি থেকে। তৃতীয়ত, টপসির এ ঘটনাকে ভিডিওচিত্রে ধারণ করে এডিসন মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানি থেকে আসা একদল কর্মী। সেই ভিডিও ক্লিপের শেষে আবার এডিসনের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়। এ তিনটি কারণ মিলিয়েই মানুষ দোষারোপ করে এডিসনকে।

এ আরোপটি বেশ জনপ্রিয় হলেও অনেক ইতিহাসবিদের মতে, এটি সম্পূর্ণ অসত্য। সময়কালের দিকে একটু লক্ষ্য করলেই বিষয়টি ধরা পড়ে। টপসির মৃত্যু হয় ১৯০৩ সালে। আর এসি বনাম ডিসি কারেন্টের দ্বন্দ্বের সমাপ্তি হয়ে গেছে এর প্রায় এক দশক আগে। এসি কারেন্ট জিতে গেছে সেই দ্বন্দ্বে। এমনকি এডিসনও পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, বৈদ্যুতিক বিপ্লবের শুরুর দিকেই যদি তিনি দ্বন্দ্বে না গিয়ে এসি কারেন্টের প্রতি মনোযোগ দিতেন, তবেই ভালো করতেন।

তাই এতটা পরে এসে আরেকটি প্রকাশ্য প্রাণী হত্যার মাধ্যমে এডিসনের নতুন করে কিছুই প্রমাণ করার ছিল না। কোনো পত্রিকার বয়ানেও এটা পাওয়া যায়নি যে, এডিসন এ হত্যাকাণ্ডের দিন উপস্থিত ছিলেন। তিনি উপস্থিত থাকলে পত্রিকায় সেটা অবশ্যই আসতো।

কিন্তু এডিসনের নাম সম্বলিত কোম্পানির টেকনিশিয়ানরা? আসলে সময়ের ব্যবধানে এসব কোম্পানির এতবার মালিকানা বদল ও বিভিন্ন কোম্পানির সাথে সংযুক্তি হয়েছিল যে, এডিসন নিজে তখন ঐ কোম্পানির সাথে ছিলেন কি না সেটাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। তাই এ টেকনিশিয়ানদের দিয়ে এ ঘটনার সাথে এডিসনের সম্পর্ক দাঁড় করানোটা অযৌক্তিক।

এ সম্পর্কিত একটি ভিডিও-ও পাওয়া যায় অনলাইনে। টপসির হত্যাকান্ডের এ ভিডিওটি ছাড়াও এ কোম্পানি আরো সহস্রাধিক ভিডিও তৈরি করেছে এডিসনের নাম ব্যবহার করে। এর অধিকাংশই তৈরি করা হয়েছে তার কোনোরকম নির্দেশনা ছাড়াই। এটা সম্ভব যে, এ ভিডিওর পেছনেও এডিসনের কোনো হাত ছিল না।

এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করলেই এ ঘটনার জন্যে এডিসনকে দায়ী করাটা সাজে না। এডিসন হয়তো কোনো সাধুপুরুষ ছিলেন না, তবে অন্তত এ ঘটনায় তার প্রত্যক্ষ কোনো হাত ছিল না। বরং মালিকপক্ষের নির্মমতার শিকার হয়েই বিদায় নিতে হয়েছিল টপসিকে। দিন বদলেছে ঘটনার সময় সহস্রাধিক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই নিষ্ঠুরতা উপভোগও করেছেন। তবে দিন বদলেছে, প্রাণিদের প্রতি মানুষের সহানুভুতি বেড়েছে। আর প্রাণির প্রতি নিষ্ঠুরতার আলোচনা এলেই উঠে আসে টপসির কথা, উঠে আসে এডিসনের কথাও; যার দায়ভার হয়তো তার নয়ই।

সূত্র: রোয়ার মিডিয়া, উইকিপিডিয়া, ডেইলি মেইল

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *