স্বাস্থ্যে চক্রের ৮ দুর্নীতি প্রতিবেদন যাচ্ছে মন্ত্রিপরিষদে

দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দীর্ঘ তদন্তের পর প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবেদনে এ খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের ৮টি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বদলি ও পদোন্নতিতে অনিয়ম; দালালদের সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলার মাধ্যমে রোগীদের জিম্মি করে রাখা; বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে অর্থ আত্মসাৎ; দক্ষ জনবলের অভাবে যন্ত্রপাতি ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে যাওয়া; দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ও রোগীদের ভোগান্তি; সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের সহযোগিতায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন, সেখানে রোগী পাঠিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায়; ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নমানের ও নকল ওষুধ তৈরি এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্য খাতে সরকারের নজরদারির অভাব ইত্যাদি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে প্রতিবেদনে ১৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি নিয়ে এখন চলছে দুদকের চূড়ান্ত পর্যালোচনা। এর পর এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের মে মাসে দুদক ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’ গঠন করে। ওই টিম স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির উৎস ও কারণ চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সুপারিশসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের এক পরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য খাতসহ অনেকগুলো খাতে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম কাজ করছে। টিমগুলো এসব খাতে কী ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে, সেবাগ্রহীতারা কী ধরনের সেবা পাচ্ছেন, কেন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং প্রত্যাশিত সেবা প্রদানে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তদন্তের মাধ্যমে এসব সমস্যা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করে থাকে। স্বাস্থ্য খাতের প্রতিবেদনটি কমিশনে পর্যালোচনাধীন আছে। পর্যালোচনা শেষে এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।

প্রতিবেদনে দুর্নীতির ৮টি উৎস উল্লেখ করা হয়েছে

এক. স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বিদ্যমান। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণার্থী বাছাই প্রভৃতিতে দলীয়করণ ও স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক অর্থ আদায়ের জনশ্রুতি আছে।

দুই. হাসপাতালের অনেক কর্মচারী দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে বহাল থাকার কারণে স্থানীয় দালালদের সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলে। এ চক্র রোগী ও তাদের স্বজনদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে অতিরিক্ত আদায় করে থাকে।

তিন. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রয় কমিটিতে নীতিবান, নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা নেই। এ খাতেও চলছে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ। ক্রয় কমিটির কার্যক্রমে সরকারের যথাযথ নজরদারি না থাকায় ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও অন্যান্য পণ্য ক্রয়ে চলে অবাধ দুর্নীতি। উপরন্তু, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে চলে সরকারি অর্থের লুটপাট।

চার. সরকারি হাসপাতালগুলোয় যন্ত্রপাতি চালানোর মতো দক্ষ জনবল নিয়োগ না দিয়েও সেসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এগুলো দীর্ঘসময় অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও মেরামতের কথা বলে আদৌ সরবরাহ ও মেরামত না করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে।

পাঁচ. সরকারি হাসপাতালগুলোয় দালাল চক্র সক্রিয়। মোটা টাকা কমিশনের লোভে অসহায় রোগীদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে এ চক্র প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফলে দরিদ্র রোগীরা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেও সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।

ছয়. যথাযথ নজরদারি না থাকায় হাসপাতালগুলোয় সরকারি ওষুধ রোগীদের প্রদান করা হয় না। এসব ওষুধের একটি অংশ কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। অথচ নথিপত্রে ঠিকই দেখানো হয় যে, এসব ওষুধ রোগীদের দেওয়া হয়েছে।

সাত. প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চিকিৎসাসেবা প্রদানের নামে টাকা কামানোর জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে তোলেন। সিভিল সার্জন অফিসের সহযোগিতায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলেও এসব সেন্টারের অধিকাংশেরই নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের কমিশন প্রদান করে। কমিশন পেয়ে চিকিৎসক-কর্মচারীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সেন্টারগুলোতে রোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

এবং আট. দেশের ফার্মাসিটিউক্যালস কোম্পানির মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যতীত বেশিরভাগ কোম্পানিই নিম্নমানের ও নকল ওষুধ প্রস্তুত করে থাকে। এসব কোম্পানি তাদের বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে বাড়তি অর্থ দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে তারা তাদের উৎপাদিত নিম্নমানের ওষুধ প্রেসক্রাইবের ব্যবস্থা করায়। এতে রোগীদের ভোগান্তি ছাড়াও চিকিৎসা ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

প্রতিবেদনে দুর্নীতি প্রতিরোধে ১৬ দফা সুপারিশ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে উন্মুক্ত স্থানে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন; ক্রয় কমিটির দুর্নীতিরোধে কমিটিতে বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্তকরণ; হাসপাতালে যন্ত্রপাতি রিসিভ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা; হাসপাতালে ওষুধ ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার মূল্যতালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা; গ্রামাঞ্চলের রোগীরা যেন দালালের প্রলোভনে পড়ে প্রাইভেট হাসপাতালে না যায় তা নজরদারিতে রাখা; ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনুমোদনহীন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া; যেসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান নেই সেগুলো বন্ধের ব্যবস্থা করা; বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক স্থাপন ও অনুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে স্থায়ী চিকিৎসক, কর্মচারী আছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া; দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নকল ওষুধ কারখানায় যেসব ওষুধ তৈরি হয় তা বন্ধে সার্ভেইলেন্স টিম গঠন করা; চিকিৎসকদের জন্য সুনির্দিষ্ট বদলি নীতিমালা প্রণয়ন; চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ফি নির্ধারণ করে দেওয়া; সেবার মান উন্নয়নে রোগীর স্বাস্থ্যবীমা চালু করা; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পৃথক করে স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে রূপান্তর করা এবং চিকিৎসা শিক্ষার মান উন্নয়নে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, প্যারামেডিকস ইনস্টিটিউটের মানোন্নয়ন করা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজামান এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু দুর্নীতির উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি প্রদানের মধ্যেই দুদকের কাজ সীমাবদ্ধ নয়। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, তাদের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশও করতে হবে দুদককে। শুধু তা-ই নয়, দুদকের এখতিয়ার আছে, যারা দুর্নীতিবাজ তাদের বিরুদ্ধে নিজস্বভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার। সেক্ষেত্রেও তাদের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ ছাড়া ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দুদক স্বাস্থ্য খাতে যেসব দুর্নীতির ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, তা রোধের সুপারিশসহ সরকারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সরকার যদি কার্যকর উদ্যোগ নেয়, তা হলেই দুর্নীতি কমবে, নয়তো নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকরে সঙ্গে যোগাযোগ করলে ফোন ব্যাস্ত পরে এই মহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয় তাই বিষয়টি নিয়ে তার বক্তব্য জানা যায়নি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের মন্তব্য জানার জন্য গতকাল রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তখন তিনি ‘জরুরি মিটিংয়ে’ আছেন জানিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেছেন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *