ভুল বাংলা বলার জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত : অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ

ঢাকা, লিগ্যাল ডেস্ক : রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন, ভুল বাংলা বলার জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে এবছর একুশে পদক প্রাপ্ত এই গবেষকের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন। মাতৃভাষা ব্যবহারে যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্ম শুদ্ধ ইংরেজিতে না হোক ভুল ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হলো এই যে, ভুল বাংলায় কথা বললে তারা লজ্জিত হয় না, বরং ভুল ইংরেজি বললে লজ্জিত হয়। এই জায়গাটিতেই উল্টো হওয়া উচিত। ভুল বাংলা বললে তরুণদের লজ্জিত হওয়া উচিত। কেননা, আমি ইংরেজিতে ভুল বললে কোন অসুবিধা নেই। কারণ ওটি আমার মাতৃভাষা নয়। ওটি ভুল হলে আমরা লজ্জা পাবো, আর মাতৃভাষা ভুল হলে আমরা লজ্জা পাবো না এই মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া উচিত।বিশ্বজিৎ ঘোষ তরুণ প্রজন্মকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে মাতৃভাষার সঠিক চর্চার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই অন্য ভাষা শিখবো। কিন্তু একই সঙ্গে মাতৃভাষাকে আমি যদি ভালো না বাসি, মাতৃভাষার সঠিক ব্যবহার না করি তাহলে আমি একজন পূর্ণ মানুষ হতে পারি না। সেটাও তরুণ সমাজকে মনে রাখতে হবে।’ মাতৃভাষার প্রতি যে আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো, তার মধ্যে দিয়ে বাঙালী জাতিসত্বার এক গৌরবময় ঐতিহ্য রচিত হয়। এই ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বাঙালীর স্বাধীকার চেতনার উন্মেষ ঘটে। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলনে শহীদদের উদ্দেশ্যে সপ্তাহব্যাপি এক স্মরণ সভার আয়োজন করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করবো না। কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভব পর হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে , কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।” (উৎস: বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ; বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত বক্তৃতা ও বিবৃতি, সম্পাদনা: রামেন্দু মজুমদার)। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ এর মানে সংবিধান যেদিন প্রণীত হয়েছে সেদিন থেকেই এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটগুলোতেও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বাংলায়। তা সত্বেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষার মধ্যে ইংরেজি ভাষার অকারণ প্রয়োগ দেখা যায়। যা ভাষার প্রতি কেবল অবমাননাই নয়। আমাদের একুশের চেতনাকে আঘাত করে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে ব্যক্তি মানসের উদ্যোগের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্যক্তিগত ভাষাপ্রীতি ছাড়া সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা যাবে না। সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার জন্য প্রত্যেকের মধ্যে দেশপ্রেম লাগে। ভাষা প্রেম দেশপ্রেমের অন্যতম উপাদান। আপনি যদি বাংলা ভাষায় কথা বলতে আত্মমর্যাদা বোধ করেন, তবেই বাংলা ভাষার প্রকৃত বিকাশ ঘটবে।’ড.বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য বাংলাভাষাকে আমাদের বৃত্তির সঙ্গে, চাকুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। ভালো বাংলা বলতে পারলে, ভালো বাংলা লিখতে পারলে আগে চাকুির পাবে, ভালো চাকুরি পাবে এই বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার।
তিনি বলেন,‘ভাষা বেঁচে থাকে সাহিত্যে। ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের মুখে। আমাদের বাংলা ভাষা এখন পৃথিবীতে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি মানুষ ব্যবহার করে। আমরা বাংলাদেশে যে সতের কোটি মানুষ তার মধ্যে তরুণের সংখ্যা অনেক। এই তরুণরা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা ভাষাকে তখনই ভালোভাবে ব্যবহার করবে যখন দেখবে যে, বাংলাভাষা ব্যবহার করে সে উন্নত জীবনের সন্ধান পাচ্ছে, চাকুরি পাচ্ছে এবং সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘সরকার আইন করে একটি কাজই করতে পারে, তা হলো যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে বাংলা পড়ানো হয়না সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে।’ উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালে দেশে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়েছে। আইন করার পরে যে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হয়েছে, তা নয়। উচ্চ আদালতে বাংলা চালু হয়নি। সেখানে আইনি পরিভাষার দোহাই দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েকজন সম্মানীয় বিচারপতি বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া যায়।
বিশ্বজিৎ ঘোষ আরো বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন একদিনে যে হবে তা নয়। এজন্য আমাদের জাতীয়ভাবে অগ্রসর হতে হবে। ব্যক্তির নিজের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *